আজ ২৯ ডিসেম্বর দেশের খ্যাতিমান চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৫ সালের আজকের এই দিনে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন গাইবান্ধায়। সেখানে ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্ট থেকে ফেরিযোগে নদী পারাপারের সময় পা পিছলে নদীতে পড়ে যান।

দীর্ঘ ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যুর তদন্ত প্রতিবেদন। খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো কূল-কিনারা। মৃত্যুর নেপথ্যে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না এমন প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায়নি।

ঘটনার এক দিন পর ৩০ ডিসেম্বর রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া কবরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত হয় মোনাজাতের মরদেহ। সেদিন চির বিদায়ের সঙ্গে প্রশ্ন রেখে যান সবার মধ্যে। সত্যি কি পা পিছলে পড়েছিলেন নাকি কোনো ষড়যন্ত্রে চলে যান না ফেরার দেশে। সেই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।

তার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গেল ২৬ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।

রংপুরের কৃতি সন্তান মফস্বল সাংবাদিকতার দিকপাল চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন একজন সফল গবেষকও ছিলেন। তার লেখনিতে উঠে এসেছিল গ্রাম-বাংলার অজানা অনেক কথা। সততা, ধৈর্য্য আর অসীম সাহসিকতাকে পুঁজি করেই তিনি সাংবাদিকতায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যার কারণে তার লেখনিতে পাঠকরা ছিল সব সময় জাগরিত সমাজের একাংশ।

ছাত্র থাকাকালীন বগুড়ার সাপ্তাহিক বুলেটিন পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। ১৯৬২ সালে স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকার কাগজ দৈনিক আওয়াজ এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর তিনি নিজেই দৈনিক রংপুর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি থমকে যায়। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে মোনাজাত উদ্দিন পূর্বদেশ ও দৈনিক সংবাদে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন। সেখান থেকে বের হয়ে ১৯৯৫ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত জনকণ্ঠই ছিল তার ঠিকানা। তিনি রংপুর কেরানিপাড়ার বাসা থেকে নানা অভাব-অনটনের মধ্যদিয়েও সাংবাদিকতা চালিয়ে যান।

মোনাজাত উদ্দিন শুধু সাংবাদিকতায় ব্যস্ত ছিলেন না। ব্যস্ততা ছিল নাটক, গল্প, কবিতা আর ছড়া লেখায়ও। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘করিম মন্ডলের বৈঠকখানা’র পাণ্ডুলিপি লেখার পাশাপাশি ভালো গীতিকার হিসেবেও তার ছিল বেশ সুনাম। তার রচিত একমাত্র নাটক ‌‘রাজা কাহিনী’।

এছাড়া মৃত্যুর আগে ও পরে মোনাজাত উদ্দিনের লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে – সংবাদের নেপথ্য, পথ থেকে পথে, নিজস্ব রিপোর্ট, কাগজে মানুষেরা, নরনারী, শাহ আলম ও মজিবের কাহিনী, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, ছোট ছোট গল্প, কানসোনার মুখ, লক্ষ্মীটারী, চিলমারীর এক যুগ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও মোনাজাতের শেষ লেখা ও শেষ দেখা ইত্যাদি।

উত্তরের অহংকার চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে ফিলিপস পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।

মফস্বল সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা দেশ বরেণ্য এই সাংবাদিকের জন্ম হয়েছিল ভাওয়াইয়ার সুরে ভরা বাহের দেশখ্যাত রংপুরের উর্বর ভূমিতে। ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী আলীম উদ্দীন আহমেদ আর মা মতিজান নেছা।

মোনাজাত উদ্দিন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তার বাবাকে হারিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন। অনেক পথ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সত্যের পথে। সেখান থেকেই সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে সত্যের আলো তুলে ধরেছেন।

মোনাজাত উদ্দিন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একটি স্মরণীয় নাম। শুধু সাংবাদিক নন তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ডেস্কে বসে সাংবাদিকতা নয়, তিনি ছিলেন তৃণমূল মানুষের সংবাদকর্মী, ছিলেন জনগণের সাংবাদিক। খবরের অন্তরালে যেসব খবর লুকিয়ে থাকে সেসব তথ্যানুসন্ধান এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে।