যুদ্ধবিমার আওতায় ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পরিত্যক্ত ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের ক্ষতিপূরণ চেয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশনের কাছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে এ সংস্থাটি।
স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে)। বিএসসির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের সাধারণ বিমা করপোরেশন এবং লন্ডনভিত্তিক বিজলে ইন্স্যুরেন্স যৌথভাবে ওই টাকা পরিশোধ করার কথা। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জাহাজটিতে গোলাবর্ষণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সাধারণ বিমার কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর সুমন মাহমুদ সাব্বির। তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই যথাসময়ে বিমার টাকা দাবি করা হয়েছে। তিনি এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী, বিজলে ইন্স্যুরেন্স ও সাধারণ বিমা করপোরেশন ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করবে। তবে ক্ষতিপূরণ কত হবে তা নির্ধারিত হবে সালিশির মাধ্যমে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই জাহাজে কোনো আন্তর্জাতিক ক্লাস সোসাইটির সার্র্ভেয়ার গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে পারবেন না। এ কারণে ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। জাহাজটি ২০১৮ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়।
তখন এটির নির্মাণ ব্যয় পড়েছিল ২৫ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার; যা বাংলাদেশের মুদ্রায় ২১৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে)। এদিকে বাংলার সমৃদ্ধি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। ওই কমিটিতে জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, অলভিয়া বন্দরে ইনার অ্যাংকরেজে থাকাবস্থায় গত ২ মার্চ বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলা হয়। এতে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান মারা যান। গত ৩ মার্চ ওই জাহাজের ২৮ জন নাবিক ও হাদিসুর রহমানের লাশ নামিয়ে আনা হয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ওইদিনই জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে জাহাজটি ওই বন্দরেই রয়েছে।
জানা গেছে, সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে জাহাজটি সেখানো পাঠানো এবং আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে ফেরত আসতে না পারার বিষয়টি বিচার বিশ্লেষণ করছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, নৌপরিবহণ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনরা।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সামনের দিনে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। এছাড়া জাহাজটিতে হামলার পর বিএসসির বিরুদ্ধে যারা বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালিয়ে আসছেন তাদের উদ্দেশ্য কী- তা নিয়েও বিভিন্ন মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি নয় মন্ত্রণালয়।
তবে ওই আলোচনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই জাহাজটি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে গিয়েছিল। জাহাজটি ২৯ জন নাবিক নিয়ে তুরস্কের ইলাগলি বন্দর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি রওয়ানা দেয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে যায়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ২১টায় ইউক্রেনের পাইলটের মাধ্যমে এটিসহ মোট ২১টি মার্চেন্ট জাহাজ কনভয় আকারে ইনার অ্যাংকরেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। তারা আরও জানান, জাহাজটি যখন ইউক্রেনের উদ্দেশে রওয়ানা হয় তখন ওই বন্দরে মার্চেন্ট শিপ যাতায়াতের ওপর বাংলাদেশ, ইউক্রেন, রাশিয়া, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও জাহাজটির সার্ভে প্রদানকারী আন্তর্জাতিক ক্লাস সোসাইটিসহ কারও কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এ কারণেই চার্টারার প্রতিষ্ঠান ডেল্টা কর্প পিটিই লিমিটেডের চাহিদা অনুযায়ী ওই বন্দরে গিয়েছিল জাহাজটি।
অলভিয়া বন্দর থেকে কৃষ্ণসাগর ফিরতে ১১১ কিলোমিটার (৬০ নটিক্যাল মাইল) চ্যানেলে ৭টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকায় পাইলট ছাড়া জাহাজটি ফিরতে পারেনি। ইউক্রেনের বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই জাহাজকে কোনো পাইলট সুবিধাও দেয়নি। তারা আরও বলেন, বর্তমানে অলভিয়া বন্দরে অনেক দেশের জাহাজ আটকা অবস্থায় রয়েছে। ওইসব জাহাজে এখনো তাদের নাবিকরা অবস্থান করছেন।
আরও জানা গেছে, ইউক্রেনে পরিত্যক্ত ঘোষণার পরই তা সাধারণ বিমা করপোরেশন, জাতিসংঘের আওতাধীন আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সাধারণ বিমা করপোরেশনের কাছে জাহাজের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার চেয়েছে বিএসসি। এ জাহাজটির বিমা চুক্তিতে সাধারণ বিমা করপোরেশনের কাউন্টার পার্ট লন্ডনের বিজলে ইন্স্যুরেন্স রয়েছে।
যুদ্ধ বিমা পলিসির আওতায় ওই ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, গত ২ মার্চ রকেট হামলার পর জাহাজটি বিকল হয় এবং ওই জাহাজে নাবিকদের অবস্থান করা তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। হামলায় জাহাজটি পরিচালনা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে সেটি আর চালানোর মতো উপায় ছিল না। এছাড়া হাদিসুর রহমানের মৃত্যুর পর সেখানে ২৮ জন নাবিক নিজেদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা দিয়ে তারা নেমে আসেন।
বাংলার সমৃদ্ধি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাহাজটি যখন আক্রান্ত হয় তখন অলভিয়া বন্দরের অভ্যন্তরীণ ও বহির্নোঙরে বিভিন্ন দেশের দুইশ জাহাজ অবস্থান করছিল। সেখানে বাংলাদেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রুপেরও জাহাজ বহির্নোঙরে ছিল। কিন্তু শুধু বাংলাদেশের পতাকাবাহী বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ওপরের অংশ ব্রিজে হামলা হয়েছে। অন্য কোনো জাহাজ আক্রান্তের খবর পাননি নাবিকরা।
এছাড়া হামলার পরপরই ওই জাহাজের কাছাকাছি তিনটি টাগবোট এগিয়ে এসেছিল। এর আগে বাংলাদেশের নাবিকরা বারবার চেয়েও টাগবোটের সহযোগিতা পায়নি। এতে নাবিকদের ধারণা হয়, লক্ষ্য করেই এ জাহাজটিকে হামলা করা হয়েছে। এতেই বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন নাবিকরা। তাদের ধারণা ছিল এ জাহাজটিতে আবারও হামলা হতে পারে। এই ভয়েই জীবন বাঁচাতে জাহাজ থেকে নেমে আসার আকুতি জানান তারা। সরকারও দ্রুত তাদের নামিয়ে নিরাপদে দেশে নিয়ে আসেন।
এদিকে পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় একটি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে এ খাতের বিশেষজ্ঞদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।