১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কবিপ্রতিভা কাজী নজরুল ইসলামকে কোলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে চেতনাগত সংকট উত্তরণ ও উজ্জীবনের জন্য তাঁকে আমাদের সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন ছিলো। ভারতীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ চেষ্টার ফলে কবিকে ঢাকায় আনা সম্ভব হয়। তিনি আর ফিরে যাননি বা ভারত সরকার তাঁকে আর ফেরত চাননি। তিনি বাংলাদেশর জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে এবং তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় যা বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় সম্মান। তাঁকে তার ইচ্ছেমতো মসজিদের পাশে আমার কবর দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে মসজিদের পাশে তিনি শায়িত আছেন। এই সব তথ্য অনেকের জানা। অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনার মধ্যদিয়ে একটি স্বাধীন দেশের কী উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল তা নিয়ে দুর্জনেরা তর্ক করতে পারেন। কবির কাছের মানুষেরাও চাননি কবি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গিয়ে থাকুন। তবু এই কবি বাংলাদেশে খুব আদর যত্নে মানে সম্মানে বেঁচে ছিলেন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে মনে প্রায় অর্ধমৃত এই কবিকে নিয়ে আমাদের যে জাতীয় লক্ষ্য ছিলো তা কী পূরণ হয়েছে? কবির মর্যাদা কী আমরা দিতে পেরেছি প্রকৃত অর্থে? তার দর্শন আদর্শ প্রতিভার আলো কী আমরা এই জাতির কাছে উপস্থাপিত করতে পেরেছি?

কবি নজরুলের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের সবচয়ে বড় সত্য হলো তিনি মানবতার পক্ষে মানুষের পক্ষে অবস্থান করেছেন। নিজের জীবনের কষ্ট গ্লানি আর অসহায়ত্বকে তিনি উপলব্ধি করে এক মানবিক দর্শনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সারা জীবন; লেটোর দল, মসজিদের মুয়াজ্জিন, হোটেলের রুটি তৈরির কাজ থেকে সব তুচ্ছ কাজ করেছেন আনন্দের সাথে। ভালোবেসেছেন মানুষকে সব পরিচয় ভুলে শুধু মানুষ হিসেবে। এই মানুষকে সবার উপরে স্থান দেবার কথা বলেছিলেন মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’—এই বাক্যই কবির মূল মন্ত্র ছিল। তাঁর রচনা, জীবন, কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে আমরা এই কথার প্রতিধ্বনি পাব বারবার। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান নারী পুরুষ ধনী গরিব বড় ছোট অভিজাত অনভিজাত সবাইকে এককাতারে এনে শুধু মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার যে প্রচেষ্টা সেটা নজরুল করেছেন বারবার। সাহিত্য রচনার সময় তিনি রচনা করেছেন গণসাহিত্য বা জনসাহিত্য। ব্রিটিশ রাজত্বে তাঁর মতো অমিত শক্তি আর দীপ্ত উচ্চারণে আর কেউ করতে পারেননি। যার জন্য জেল খেটেছেন নির্দ্বিধায়। সাধারণ খেটে খাওয়া মুটে মজুর শ্রমিকদের জন্য তিনি কবি এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জন্য সাহিত্য করতে চান একথা অজস্র বার বলেছেন। চির রোম্যান্টিক প্রেমের এই কবির এই ছিলো মূল প্রেরণার জায়গা। কবিতা ও গানে তিনি রোম্যান্টিক ধারার প্রস্রবণ ঘটিয়েছেন এটা ঠিক তবে একই সাথে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসে আমরা দেখব প্রকৃত নজরুলের স্বরূপ। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের কবি নজরুলকে লক্ষ করলে বোঝা যাবে তাঁর আত্মার ক্রন্দন।

পিছিয়ে পড়া সাধারণ বঞ্চিত গ্রাম্য মানুষের জন্য তিনি বারবার তার আকুতির কথা বলেছেন। তাদের মুক্তির জন্য স্বাধীনতার জন্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। আর বলেছেন, সাহিত্য হবে তাদের জন্য অর্থাৎ জনসাহিত্য। তারা যেন আমাদের সাহিত্য পড়ে অনুপ্রাণিত হয় সেরকম বিষয়বস্তু ও প্রকরণ আমাদের ব্যবহার করতে হবে। ১৯৩৮ সালে দৈনিক ‘কৃষক’ পত্রিকার কার্যালয়ে জন-সাহিত্য সংসদের উদ্বোধনে সভাপতির অভিভাষণে কবি এ বিষয়ে তাঁর মতামত তুলে ধরেন। উঁচুতলার মানুষ নিচের দিকের দরিদ্র মানুষদের যে চোখে দেখে তা বন্ধ করে তাদের সাখে মিশে তাদের মতো সাহিত্য রচনা করে তাদেরকে জাগিয়ে তোলার কথা কবি বলেছেন নানা উদাহরণ দিয়ে। কবি সেখানে উল্লেখ করেছেন; আজকাল জনসাধারণের জন্য দরদ জেগেছে সবার মধ্যে, কত রকমের ইজম মতবাদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। যা হোক, তাদের এই দরদ যদি সত্যিকারের প্রাণের দরদ হয়, তবেই মঙ্গলের। বাহিরে থেকে তাদের দরদ দেখালে তারা বিশ্বাস করে না। তাদেরই একজন হতে হবে। তাদের কাছে টর্চলাইট নিয়ে গেলে তারা সরে দাঁড়াবে; কেরসিনের ডিবে নিয়ে গেলে তার থেকে যতই ধোঁয়া বের হোক না কেন তাদেরকেই আকর্ষণ করবেই। কারণ, তারা টর্চলাইটে অনভ্যস্ত। ওতে ওদের চোখ ঝলসায়। কেরসিনের ডিবে ওদের নিজেদের জিনিস। অবশ্য যাদের টর্চলাইটই সম্বল, তাদের পথ শহেরর দিকে। গ্রামের দিকে জনসাধারণের দিকে গেলে তাদের ঠিক হবে না। যারা ইনটেলেকচুয়াল (Intellectual) তাদের আমি সাহিত্য গড়ার জন্য আসতে বলি না। কিন্তু এমনও সাহিত্যিক আছেন, যাদের সম্বল কেরসিনের ডিবে। এ পথ কিন্তু সোজা নয়, কঠিন। ত্যাগ চাই এর পেছনে। পরে দুঃখ করলে কোনো লাভ হবে না। জনসাধারণের যে সমস্যা, তা সাহিত্যিকেরাই সমাধান করতে পারবেন।’ লক্ষ করার ব্যাপার যে তিনি মূল জায়গায় পৌঁছে ছিলেন। অর্থাৎ, জাতির সার্বিক কলাণের জন্য জনসাধারণকে উজ্জীবিত করতে হবে, তাদেরকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং পথনির্দেশনা দিতে হবে সঠিকভাবে তাদের কাছের মানুষ হয়ে। সাহিত্য পারে তাদেরকে দেশের মূল স্রোতের সাথে মিশিয়ে যাবতীয় সদর্থক কাজে তাদের ব্যাপৃত রাখতে। আমাদের নেতারা বা সাহিত্যিকরা জনসাধারণকে মূল্যায়ন করতে চায় না। এটা এদেশের জন্য বড় সমস্যা।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর আমাদেরকে জাতির সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারিনি। এখন কার্যত দেশ এক সংকটের মুখে যখন দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ। এর সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক নানা সংস্রব তাতে কোনো সন্দেহ নেই তবে আমাদের করণীয় কম নয়। আমরা আমাদের দেশের লোকদের চিনতে পারিনি। অসম্প্রদায়িকতার দেশে সবচেয়ে বড় অসম্প্রদায়িক হলো এদেশের সাধারণ জনগণ। তাদেরকে বোকা ভাবা বা অন্ধকারে রাখা বা গুরুত্বহীন করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কবি নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন আমাদেরকে পথ দেখাতে পারে। তিনি নিজের জীবন দিয়েই প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি কত বড় মাপের অসম্প্রদায়িক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা সবার জানা এবং তার রাজনৈতিক প্রবন্ধে তিনি ভারত মুক্তির মন্ত্র দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর কবিতা গান বাঙালির অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস ছিলো। তবে স্বাধীনতার পর আমরা কবি নজরুলকে খুব বেশি মনে রাখিনি। তাঁর সাহিত্যের বাণীকে গ্রহণ করিনি। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিলো অসাধারণ। সাধারণ জনগণকে কীভাবে আমরা দেশের সামগ্রিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি সেকথা নজরুল স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন। পাশাপাশি নিজ জাতি বা কওমকে যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে সেবিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। কারো কারো মনে হতে পারে কবির কথা ছিল তো পরাধীন ভারতবর্ষের জন্য প্রযোজ্য। কার্যত জনগণ আগের অবস্থানে আছে এবং ওপরতলার প্রভাব আরো বিস্তৃত হয়েছে। জমিদার না থাকলেও অজস্র প্রকার জমিদার তৈরি হয়েছে নতুন নামে। তারা জনগণকে নিঃস্ব করছে অভিনব কৌশলে। নজরুল যা বলেছিলেন তা হলো; নিজেদের কওমের যদি মঙ্গল করতে চাই, তবে তার জন্য অপর কাউকে গাল দেবার দরকার পড়ে না। যারা অপরকে গালি দিয়ে কওম কওম করে চিৎকার করে, তারা ঐ এক পয়সায় মক্কা-মদিনা-দেখানেওয়ালাদেরই মতো। তারা কওমের জন্য চিৎকার করতে করতে হয়ে যান মন্ত্রী, আর ত্যাগ করতে করতে হয়ে যান জমিদার। কওমের খেদমত করতে করতে কওম যাচ্ছে গরিব হয়ে, আর গড়ে উঠছে নেতাদের দালান-ইমারত।’

রুদ্র বীণা হাতে যে কবির আবির্ভাব, রক্ত-নেশা যার সমস্ত কবিতায় সেই কবিকে আমরা যে মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে চেয়েছিলাম তা পারিনি। নতুনের কেতন উড়িয়ে তিনি এসেছিলেন আমাদের অবরুদ্ধ মানবতার মুক্তি দিতে, সব শৃঙ্খলিত চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তা গ্রহণ করতে পারিনি। বরং, আমরা তাঁকে যে যার হীন স্বার্থে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করেছি। কবি নজরুলকে একসময় কাফের বলেছি আবার এক সময় বলেছি ইসলামের ঝান্ডা হাতে অন্যতম বীর। কারণ তিনি ইসলামি জাগরণমূলক গান লিখেছিলেন। আরব জাতীয়তাবাদের মন্ত্র দিয়ে বাঙালিকে জাগাতে চেয়েছিলেন। অন্য দল তাঁকে জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারি মনে করেছেন। এসব শ্রেফ কবি নজরুলকে না বুঝে নিজেদের স্বার্থে মোহাবিষ্ট গোষ্ঠীর কাজ। কবি জাত পাত ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠীচিন্তার বাইরে এক মহামানব সমাজের স্বপ্ন দেখতেন।

এখন সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ কবি নজরুল বড়ই প্রাসঙ্গিক। তিনি যে আলো হাতে এসেছিলেন, সেই আলোকবর্তিকার খুবই প্রয়োজন আমাদের। একটি উজ্জ্বল সংস্কৃতির উত্তরাধিকার রয়েছে আমাদের। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একসাথে শুধু শান্তিতে বাস করেনি বরং প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহমর্মী হয়েছে বিপদে আপদে আনন্দে হাসি খুশিতে। আমরা বিচিত্র মানব সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে ঐক্যের গান গাইতে দেখেছি—এই মহামানবের সাগরতীরে। সেটা আমাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সভ্যতা, গ্রহণে পালনে আচরণে যা পৃথিবীর সেরাতে পরিণত হয়েছিল। কবি নজরুল সেই ঐতিহ্যবান সভ্যতা সংস্কৃতি ও জীবনধারার মানসপুত্র। আমরা তার চিন্তাধারা গ্রহণ করে তাকে সত্যিকার অর্থে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি।

সম্প্রতিকালে বাংলাদেশ যুগপৎ উন্নতি ও এক অনিশ্চয়তা দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই সংকট আমাদের চিন্তাও বিবেচনার সংকট বলে মনে হয়। এটি কখনো আমাদের কাম্য নয়। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যাব। তবে তার জন্য চিন্তা দর্শন ও মৌলিক বোধের দৈন্য ঘোচাতে হবে। আর এর পথ আগেই দেখিয়ে গেছেন কবি নজরুল। বৈশাখের রুদ্র আহবানে সব মলিনতা যেমন দূর হয়ে যায় তেমনি তেজোদীপ্ত বজ্রবাণী আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে। এক সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে তার বাণীর প্রচার প্রসারে এবং গ্রহণে।