সদ্য বিদায়ি অর্থবছরেও (২০২০-২১) রপ্তানি আয়ে করোনার ধাক্কা মোকাবিলা করতে হয়েছে। আলোচ্য এই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে এর আগের অর্থবছরে বিশ্বজুড়ে প্রথমবারের মতো করোনার উল্মম্ফনে দেশের রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমেছিল ২৬ শতাংশ। স্মরণকালের মধ্যে রপ্তানি আয়ে এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। তবে বিদায়ি অর্থবছরে ওই বড় পতন থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসা সম্ভব হলেও করোনার ধাক্কা চলছেই। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।
ইপিবির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদায়ি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৮৭৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয় ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। তখনও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমে যায় ২৬ শতাংশ। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়েও। করোনার ঊর্ধ্বগতি এখনো চলছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রপ্তানি পণ্য হিসাবে তৈরি পোশাক খাত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সরকার দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে এবং রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে প্লাস্টিক, চামড়া, কৃষি, আইসিটি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে রপ্তানি নীতিমালা করা হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা ও আয় বৃদ্ধিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি আজ সরকারের পক্ষ থেকে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ঘোষণা করা হবে।
ইপিবি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮৪ শতাংশ। ফলে তৈরি পোশাক খাতে আয় সামান্য কমলেই তা পুরো রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদায়ি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় কমেছে তৈরি পোশাক খাতে। বিদায়ি অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৩৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমেছে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার। আয় হয়েছে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ডলার। আয় বেশি হয়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এছাড়া ওভেন গার্মেন্ট খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। আয় কমেছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ওভেন পণ্যের প্রকৃত রপ্তানি আয় কমায় সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। কিন্তু নিটওয়্যারের রপ্তানি আয় ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে।
নিট পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মূল্য সংযোজন বেশি হওয়া নিটওয়্যারে রপ্তানি বাড়ছে। নিটওয়্যারের অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। অন্যদিকে ওভেন পণ্যের প্রকৃত রপ্তানি কমছে। নিটওয়্যারের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং ওভেনের কমে যাওয়ার কারণে আমাদের স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। ওভেন পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আর নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফ্রোজেন ও লাইভ ফিশ খাতে বিদায়ি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৭ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। কমেছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। উৎপাদন খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৩ হাজার ৭২৫ কোটি ২৮ লাখ ডলার। আয় কম হয়েছে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাসায়নিক পণ্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ২৮ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে এ খাতে আয় বেশি হয়েছে ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। প্লাস্টিক পণ্য খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ১১ কোটি ৫২ লাখ ডলার। সেক্ষেত্রে ঘাটতি আছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর বাইরে পাট ও পাটজাত পণ্যের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। আয় কমেছে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। হেডগিয়ার খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ কোটি ডলার, আয় হয়েছে ২২ কোটি ডলার। আয় কম হয়েছে ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ডলার। আয় বেশি হয়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএফইএ) বলছে, করোনার কারণে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ধসের দিকে ছিল। তবে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। রপ্তানি কম হলেও আয় বেড়েছে। আর করোনার মতো অস্থির পরিস্থিতিতেই এবার কোরবানি ঈদে চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সবাই আর্থিক সংকটে আছে। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় কোনদিকে যাবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না।