যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক পরামর্শক এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক স্পাইওয়্যার বাণিজ্যে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে নতুবা বারবার এমন এক বিশ্বের মুখোমুখি হতে হবে যেখানে কোনও মোবাইল ফোনই রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত হ্যাকারদের কাছ থেকে নিরাপদ থাকবে না।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালানোর চাঞ্চল্যকর তালিকা রোববার ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন স্নোডেন।

২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট নজরদারি কর্মসূচির তথ্য ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক এই সদস্য। সেই সময় তিনি এ ধরনের ম্যালওয়ার প্রস্তুতকারকদের ‌‘একটি শিল্প যার অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

বিশ্বের প্রথম সারির মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের ফোন নম্বরে পেগাসাসের মাধ্যমে নজরদারি চালানো বা চালানোর চেষ্টার তালিকা পাওয়ার পর ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান, ভারতীয় দ্য ওয়্যারসহ ১৬টি পত্রিকার এক কনসোর্টিয়ামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টিকারী এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর স্নোডেন ওই মন্তব্য করেন।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হাতে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি ডেটাবেইস পৌঁছেছে, যেখানে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা রয়েছে।

রোববার এই তালিকা প্রকাশ শুরুর পর ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সিএনএন, রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস, এপি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিক রয়েছেন। ৪৫টি দেশের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে ওই তালিকায়, তার মধ্যে ১ হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশসমূহের।

গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকরা এদের বিষয়ে তৎপর ছিল এবং ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ দৃঢ়ভাবে মনে করে যে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই নম্বরগুলো।

বিশ্বজুড়ে নজরদারির মুখে থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে কারা কারা রয়েছে, তাদের নাম অচিরেই প্রকাশ করবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’। এই ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিক ছাড়াও ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরও রয়েছে।

কোনো কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বরও থাকার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, ক্ষমতাবানরা তাদের স্বজনদের ওপরও গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গার্ডিয়ানের সঙ্গে আলাপকালে স্নোডেন বলেছেন, সবচেয়ে আক্রমণাত্মক নজরদারির আওতায় আরও ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে কীভাবে আনা যায়, তা কর্তৃত্ববাদী শাসকরা বাণিজ্যিক ম্যালওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, চিরায়ত পুলিশি অভিযানে সন্দেহভাজনের ফোনে বাগ অথবা ওয়্যারটেপ বসানো হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কারও বাড়িতে প্রবেশ অথবা তাদের গাড়ি কিংবা অফিসে যেতে হয়। অথবা তাদেরকে একটি ওয়ারেন্ট জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক স্পাইওয়ার অধিকসংখ্যক মানুষকে নিশানা করার জন্য মূল্য-সাশ্রয়ী। যদি তারা সামান্য ব্যয়ে এবং কোনও ঝুঁকি না নিয়ে দূর থেকে একই কাজ করতে পারে তাহলে তারা এটি সবসময় করবে। এমনকি যাদের ক্ষেত্রে হালকা স্বার্থের বিষয় জড়িত রয়েছে, তাদের প্রত্যেককেই কর্তৃত্ববাদী শাসকরা নজরদারির আওতায় আনবে।

স্নোডেন বলেছেন, আপনি যদি এটার বিক্রি থামাতে না পারেন তাহলে এটি কেবলমাত্র ৫০ হাজার মানুষকে নিশানা বানাবে না। বরং এটি ৫ কোটি মানুষকে নিশানা করবে।