আফগানিস্তানে ভয়ঙ্কর অমানবিক জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান দুই সপ্তাহের বেশি আগে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও তার সব সেনা আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে; কিন্তু এখনো সরকার গঠন করতে পারেনি তালেবান। এরই মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে লোভাতুর তালেবানের মধ্যে কোন্দলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে তালেবানের গোষ্ঠীগত বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া নিয়ে হাক্কানি গোষ্ঠী এবং কান্দাহারের মোল্লা ইয়াকুব গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এই বিরোধের জেরে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। যদিও দুই পক্ষের শীর্ষ নেতা ও অর্থদাতা চীনের হস্তক্ষেপে বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
তালেবানের সেনাবাহিনীর দায়িত্বে রয়েছে মোল্লাহ ইয়াকুব গোষ্ঠী। হাক্কানি গোষ্ঠী কাবুল নিয়ন্ত্রণ করে এবং মোল্লাহ ইয়াকুব গোষ্ঠী কান্দাহার নিয়ন্ত্রণ করে। তালেবান নেতৃত্ব ও হাক্কানি নেতৃত্বের মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে। তালেবানের একটি সূত্র সিএনএন-নিউজ১৮ কে জানিয়েছে, ইরানের মডেলে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে যেখানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল ভূমিকা পালন করেন, এমনকি প্রেসিডেন্টের চেয়েও তিনি বেশি ক্ষমতাবান। ১১ থেকে ৭২ সদস্যের একটি কাউন্সিলের সর্বোচ্চ নেতা হতে পারেন হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। তিনি প্রকাশ্যে তেমন একটা আসেন না। কান্দাহার থেকে তিনি কাজ করছেন।
মূলত ক্ষমতা নিয়েই মোল্লাহ ইয়াকুব এবং হাক্কানি গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ইয়াকুব গোষ্ঠী; কিন্তু হাক্কানি গোষ্ঠী সেখানে নিজেদের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠছে। কেবল তাই নয়, মোল্লাহ ইয়াকুব নাকি স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন, যারা দোহায় তাদের প্রধান কার্যালয়ে বসে আছেন, তাদের হুকুম শুনতেও তিনি রাজি নন। তালেবানের প্রথম আমির-উল-মোমেনিন মোল্লাহ ওমরের ছেলে ইয়াকুব যিনি মন্ত্রিসভায় সামরিক বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চান। মোল্লাহ ঘানি বারাদারও একই মত দিচ্ছেন।
কেবল হাক্কানি বা ইয়াকুব গোষ্ঠীই নয়, তালেবানের অন্য গোষ্ঠীগুলোও নিজেদের অধিকার নিয়ে সরব হতে শুরু করেছে। এর ফলে দেশটিতে ফের একটা গৃহযুদ্ধ শুরু হবে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিল, তখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার হয়ে গিয়েছিল তারা। সূত্রের খবর, সেই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই কাবুলে তালেবানের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক চালাচ্ছেন তালেবান প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত চীনের হস্তক্ষেপে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে নতুন সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠনে আগেই ‘ঐক্যমতে’ পৌঁছেছে তালেবান ও অন্যান্য আফগান নেতারা। তালেবানের শীর্ষ নেতাকে সর্বোচ্চ আসনে রেখে তার অধীনে এই সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। শুক্রবারই (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জুমার নামাজের পর এই সরকার গঠন করা হতে পারে।
শুক্রবার সকালে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাবুলে নতুন সরকার গঠন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের দিকে কঠোর নজর রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
কারণ অতীতের কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে তালেবান অনেক সহনশীলভাবে দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার করেছে। আর এ কারণে সরকার গঠনের পর অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নারী অধিকার রক্ষায় তালেবানের নীতি ঠিক কী হয়, সে বিষয়ে নজর রাখছে পুরো বিশ্ব।
তালেবানের দু’টি সূত্র বার্তাসংস্থা এএফপি’কে জানিয়েছে, শুক্রবার জুমার নামাজের পর কাবুলে নতুন সরকার কাঠামোর ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। গত সোমবার রাতে মার্কিন বাহিনী চূড়ান্তভাবে আফগান ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশটিতে নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে বেশ কিছু সূত্র এএফপিকে জানায়, শুক্রবার জুমার নামাজের পর মন্ত্রিসভার ঘোষণা আসতে পারে। তালেবান কর্মকর্তা আহমাদুল্লাহ মুত্তাকি টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় জানিয়েছেন, কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে।
টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আসন্ন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে সব বন্দোবস্ত করছে। আসন্ন অনুষ্ঠানে আফগানিস্তানের নতুন সরকারের ঘোষণা করা হবে।’ তার টুইটে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কিছু ছবিও পোস্ট করেছেন তিনি।
আফগান গণমাধ্যম তোলো নিউজ জানিয়েছে, সরকার গঠনের ঘোষণা আসন্ন। তালেবান প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে যাচ্ছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবেন তিনি। দ্বিতীয় প্রধান হবেন নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের ব্যাপারে ধীরে চলো (ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ) নীতি অবলম্বন করছে।
তবে শুক্রবার সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বার্তায় তালেবানের মুখপাত্র বলেছেন, আফগানিস্তানে দূতাবাস চালু রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম আরও বাড়ানোর কথাও জানিয়েছে বেইজিং।