(সাদত হাসান মান্টোর মতো দুঃসাহসী ও স্পষ্টবাদী লেখক শুধু উর্দু সাহিত্য নয় এই উপমহাদেশের সাহিত্যজগতেই বিরল। মুন্সী প্রেমচাঁদের পরে উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যে এত শক্তিশালী গল্পকারের আবির্ভাব ঘটেনি বলে সমালোচকদের ধারণা। বেপরোয়া ও অদম্য সাহসী এই লেখক সারাটা জীবন সামাজিক অসাম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লেখনী চালনা করে গেছেন। মমতার সঙ্গে এঁকে গেছেন দলিত ও নিম্নবর্গের মানুষের বিষাদগাঁথা। খুশবন্ত সিং তাকে বলেছেন―মাস্টার স্টোরিটেলার। লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার মতে : এখনও মান্টোর কোনো সাহিত্য-প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সালমান রুশদি মান্টোকে বলেছেন : আনডিসপিয়ুটেড মাস্টার অব মডার্ন ইন্ডিয়ান সর্ট স্টোরি।

জন্ম হয়েছিল তার ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার সাম্বরালায়। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি, লাহোরে। বয়স তখন তেতাল্লিশও হয়নি। এই স্বল্প সময়ের জীবনে রচনা করেছেন ২২টি গল্প সংকলন, ১টি উপন্যাস, ৫টি বেতার নাটকের সংকলন, ৩টি প্রবন্ধের বই, ২টি স্মৃতিকথার সংকলন ও বেশকটি ফিল্ম-স্ক্রিপ্ট। অশ্লীলতার অভিযোগে অন্তত ৬ বার মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিবারই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। নিজের এপিটাফ নিজেই লিখে গেছেন মান্টো : Here lies Saadat Hasan Manto. With him lie buried all the arts and mysteries of short-story writing… Under tons of earth he lies, wondering who of the two is the greatest short-story writer : God or he.

মান্টোর মৃত্যুর বহুদিন পরে লাহোরে এক ঘরোয়া আড্ডায় তাকে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তার তিন কন্যা নিঘাত, নুজহাত, নুসরাত, বোন নাসিরা ইকবাল ও শ্যালিকা জাকিয়া জালাল। ওই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্যে।)

নাসিরা ইকবাল : একদিন স্কুল থেকে ফিরে মান্টো ঘোষণা করল, সে তাদের ম্যাগাজিনে লিখবে। আম্মাজান একথা শুনে কিছু বললেন না, কিন্তু আব্বা রেগে গেলেন। বললেন, খবরদার ওসব করতে যেও না। ওগুলো ঠিক কাজ নয়। তাকে অন্যকিছু না করে শুধু পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলা হলো। আব্বা কথায় কথায় তার বড় তিন ছেলের উদাহরণ টানতেন (এরা তিনজনই ছিল নাসিরা ও মান্টোর সৎভাই।) তার চোখে ওরা সবাই ছিল মেধাবী। তিনি সব সময় মান্টোকে বলতেন, ওদের মতো হও, ওদের মতো সবকিছু কর।… তাকে লিখালিখি করবার অনুমতি দেওয়া হতো না। আব্বা ধারেকাছে থাকলে মান্টো কিছু লিখত না। পরে লিখত। আমাদের আম্মা নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করার ব্যাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করতেন। একদিন সাদত একটা গল্প লিখে ঘোষণা করল, গল্পটা সে একটা বড়কাগজে পাঠাবে। আমাদের কাজিন ও পরিবারের অন্য সবাই একই এলাকায় থাকত (কোচাভাকিলান, অমৃতসর)। মান্টো জানাল, গল্পটা সে সেই সময়কার বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘হুমায়ুনে’ পাঠাবে। সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি নবীন লেখক। প্রথম দিককার কাঁচা লেখাটা হুমায়ুনের মতো খ্যাতনামা পত্রিকায় দিতে চাও!’ মান্টো বলল, ‘হ্যাঁ।’ কদিন পরে তাকে খুব মনমরা ও বিমর্ষ মনে হলো। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারও সঙ্গে মারামারি করেছ নাকি?’ ‘কই না তো’, জানাল সে, ‘না, মারামারি বা ঝগড়াঝাটি হয়নি কারও সঙ্গে, তবে বড়আপা আর চাচার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই বেরিয়ে এসে ঠাট্টা করে বলল, ওই দেখো লেখক যাচ্ছে।’ আম্মা কোনো কিছুতে কান না দিয়ে যা সে লিখতে চায় ও যেখানে লেখা পাঠাতে চায় সেখানে পাঠাতে বললেন।

নিঘাত : আমরা তখন খুব ছোট, আমার মনে আছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা আব্বুর বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আব্বু আমাদেরকে তার পেটের ওপর বসিয়ে গল্প করতেন আর খেলতেন আমাদের সঙ্গে।

নাসিরা ইকবাল : একবার তিন বোনেরই হাম উঠল। মান্টো সারা রাত মেঝমেয়ের খাটের পাশে জেগে রইল। বলল, এই মেয়েটা আমার মতোই অস্হির। ওর প্রতি নজর রাখতে হবে। আমি আর ওর স্ত্রী সাফিয়া অন্য দুই মেয়ের দেখভাল করছিলাম।

নুসরাত : আমি ছিলাম সবার ছোট। নাজুক প্রকৃতির ছিলাম বলে আব্বু কখনও আমার সঙ্গে রাগারাগি করতেন না। রাগ উঠলে তিনি আমার মেঝবোন নুজহাতের সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করতেন। আমি তাতে ভয় পেয়ে যেতাম। আব্বু আমাকে জুজিয়া জি বলে ডাকতেন।

নাসিরা ইকবাল : নুজহাতকে সে খুব বেশি ভালোবাসত। প্রায়ই বলত, ও আমার সত্যিকার মেয়ে।

নুজহাত : ঠিকই। মেজাজমর্জির দিক থেকে আমি আব্বুর মতো ছিলাম। আমার ভেতর তিনি খানিকটা নিজেকে দেখতে পেতেন।

জাকিয়া জালাল : আমি তার সবচেয়ে ছোট শ্যালিকা। ঠাট্টা করে বলতেন, শ্যালিকারা আমার বাড়ির সবকিছুর অর্ধেক মালিক। তোমরা সব বোন যদি এই অধিকার ফলাতে আসো তাহলে আমাকে পথে বসতে হবে। খুব স্নেহপ্রণব মানুষ ছিলেন তিনি।

নুসরাত : তার সুরুচির ব্যাপারে আম্মা প্রায়ই বলতেন আমাদের। লেখার জন্যে সব সময় উন্নত মানের দামি কাগজ ও কলম ব্যবহার করতেন আব্বু।

নুজহাত : হ্যাঁ, শুধু কাগজকলমই নয়, ভালো মানের জুতাও ব্যবহার করতেন তিনি। তার একজোড়া পুরনো জুতা আমাদের বাসায় ছিল। এখন কোথায় আছে জানিনে।

নিঘাত : আমাদের আম্মা ছিলেন সাদাসিধে ধরনের মানুষ। আব্বু তার চুল বেঁধে দিতেন, কাপড় ইস্তিরি করতেন, এমনকি রান্নাও করতেন। রান্না করতে পছন্দ করতেন তিনি। তার তৈরি বিশেষ পদ ছিল পাকৌড়া।

জাকিয়া জালাল : মনে আছে যুদ্ধের সময় বোম্বেতে জিনিসপত্রের আকাল ছিল। সবকিছুই চলে গিয়েছিল কালোবাজারিদের হাতে। তারপরও তিনি খুঁজে পেতে সেরা জিনিসটা আনতেন। আমার বোন সাফিয়া অভিযোগ করতেন, এসব জিনিস কিনে টাকা নষ্ট করার দরকার কী। তিনি কর্ণপাত করতেন না। স্পেশাল ও ভালো―ভালোসব জিনিসের প্রতি দুর্বলতা ছিল তার।

নিঘাত : পরে তো আমরা পাকিস্তান চলে গেলাম। তখন খুব কষ্টেসৃষ্টে দিন চলত আমাদের।

জাকিয়া জালাল : বোম্বেতে তার সময়গুলো কেটেছে চমৎকার।

নুজহাত : বোম্বেতে আমাদের বাসার ফোনটা যখন বাজত আব্বু ফোন ধরেই বলতেন, ওয়ান টু, মান্টো নয়। সেই সময় তার বাসায় ফোন ছিল―ভাবুন একবার।

নিঘাত : হ্যাঁ, ফোন ধরে ঠাট্টা করার অভ্যাস ছিল আব্বুর। তিনি গুরুগম্ভীর স্বরে ওয়ান টু বলার পর অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা বললে আব্বু বলতেন, আসলে ওয়ান টুর বাবা লাইনে আছে।

নুজহাত : আমরা শুনেছিলাম, একদিন আব্বু ক্রমাগত এমন এক লোকের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছিলেন যার ধারণা মান্টো সাহেব স্টক একচেঞ্জের দালাল। শেষে মান্টো বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আরে ভাই নিষ্পত্তি করে ফেলুন তো। পরে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তিনি এমন কথা বলেছিলেন, মান্টো জানান―লোকটা যে-ই হোক না কেন, হয় সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা কেউ তার ক্ষতি করেছে।

নুসরাত : এখনই কেবল আমরা তার লেখার রয়ালটি পেতে শুরু করেছি। ৩৫ বছরে আমরা রয়ালটি বাবদ কানাকড়িও পাইনি। প্রথম বারের মতো লাহোরের সাং-ই-মিল পাবলিসার্স কিছু টাকা আমাদের পরিবারকে দেয়। এখন আম্মাজানের কথা খুব মনে পড়ে। অনেক কষ্ট করে গেছেন তিনি।

জাকিয়া জালাল : আমরা সবাই মিলে একই বাড়িতে থাকতাম ও সবকিছু ভাগাভাগি করে নিতাম। খাওয়া দাওয়াও করতাম একসাথে।

নিঘাত ‍: আমাদের ফুপুআম্মাও (নাসিরা ইকবালকে দেখিয়ে) আমাদের সঙ্গে থাকতেন।

নাসিরা ইকবাল : আমার স্বামীর মৃত্যুর পর মান্টো তার সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে এসেছিল আমাকে। বলেছিল, তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই একা একা বুড়ো হতে চাও না। আমাদের সঙ্গে থাকো।

জাকিয়া জালাল : তার একমাত্র দুর্বলতা ছিল মদ্যপান। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও আন্তরিক। ভেতরে বাইরের কোনো পার্থক্য ছিল না।

নুজহাত : মনে আছে, স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম আব্বু ডালিমের দানা প্লেটে নিয়ে বসে আছেন। আমাদের খাওয়াবেন। প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের দাওয়াত দিয়ে আনা হতো। তারাও মহাসমারোহে ডালিম খেত আমাদের সঙ্গে।

নিঘাত : আমাদের বাসার সামনের মাঠে কাবাডি খেলতাম আমরা।

নুজহাত : আমরা বাচ্চারা সবাই একসঙ্গে থাকতাম ও খেলতাম বলে প্রায়ই ঝগড়া ও মারপিট লেগে যেত। বিশেষত আমার সঙ্গে বেশি মারামারি হতো শহিদের (শহিদ হামিদ ও জাকিয়া জালালের ছেলে। মান্টোর ছোট মেয়ে নুসরাতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার)। আব্বু তাকে বলতেন, শিগগির ওপরে যাও। তোমরা দুজন সারাক্ষণ ঝগড়া করো। পরক্ষণেই বলতেন, এই শহিদ একটা ছিঁচককাঁদুনে ছেলে। ওকে তাড়াতাড়ি ওপরে নিয়ে যাও।…