মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া যেকোনো সময় শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। প্রত্যাবর্তন শুরু করতে সহায়ক মাধ্যমগুলোতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা। তবু চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয়নি। বরং দেড় বছরের বেশি সময় করোনা মহামারি ও মিয়ানমারে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন মনোযোগ হারাতে বসেছে। শুধু তাই নয়, কবে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে আর সেটা কাদের মাধ্যমে হবে তা এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। তবে রোহিঙ্গারা যে স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তারা বলছেন, জাতিসংঘ, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশ কারও পক্ষেই রোহিঙ্গাদের দাবি-দাওয়া পূরণ করে রাখাইনে ফেরত পাঠাতে পারবে না। যতদিন না রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গিয়ে নিজেদের অধিকার আদায় না করে নেয়, ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না।

এত কিছুর পরও রোহিঙ্গা সংকটের চার বছর পার হলেও প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি নেই। মিয়ানমারে প্রায় গৃহযুদ্ধাবস্থা বিরাজ করায় বিষয়টি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জেনারেলরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। রোহিঙ্গা নিয়ে তাদের আলোচনার সময় নেই।

চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় স্থবির হয়ে আছে। ভারতও জাতিসংঘে প্রকাশ্যে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনঠাসা বাংলাদেশ। সামরিক শাসন এবং আফগানিস্তানে নতুন করে শরণার্থী সমস্যার কারণে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকারেও নেই এ সংকট। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও শুরু করেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনা অভিযান শুরু হলে রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। ওই সময় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল লক্ষাধিক। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। গত চার বছরে আরও দুই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু সেই আলোচনা যে লোকদেখানো তা সহজেই অনুমেয়।

মিয়ানমার রাখাইনে গণহত্যা চালিয়েছে। গণহত্যার দায়ে দুটি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী রায় দিয়েছে। অপরদিকে গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচার শুরু করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। জাতিসংঘ অবশ্য এটাকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৭/৭৮ সালে এবং পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে এসেছিল। তারা তখন ফিরে গেলেও এবার প্রত্যাবাসনে সমস্যা হচ্ছে।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ জাতিসংঘের উপস্থিতি ভাসানচরে দেখা যাবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিঠিতে রোহিঙ্গা ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আফগানিস্তানের শরণার্থী ইস্যু সামনে আসায় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ যাতে পিছিয়ে না যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ সজাগ। বাংলাদেশের তরফে বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বরাবরের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এদিকে ইয়াঙ্গুনের একটি সূত্র যুগান্তরকে বলেছে, মিয়ানমারে সামরিক শাসন এবং গৃহযুদ্ধ থাকার কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। কোভিড-১৯ মহামারির অবস্থা খুবই খারাপ। এই সময়ে গণতন্ত্র ফেরানোর প্রচেষ্টা চালানো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অগ্রাধিকার।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরকালে তার এজেন্ডায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাৎক্ষণিক সমস্যাটাই অগ্রাধিকারে থাকে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশ বিপদে আছে, এটা ঠিক। কিন্তু জোর করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়ে গত দেড় বছরের বেশি সময় থেকে এখন অবধি বিশ্বের মনোযোগ করোনা মহামারিতে। যার কারণে ঢাকা চাইলেও প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কিছু করার সুযোগ ছিল না। তবে মিয়ানমারকে চাপে রাখার বিষয়টি এবং রোহিঙ্গা ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।