প্রবাদের সঙ্গে বাংলার মানুষ সবাই কমবেশি পরিচিত।  কিছু প্রবাদ আসলে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে। আজও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় এমনই নানা প্রবাদ।

অঞ্চলভেদে প্রবাদের যে কতো রকমফের আছে তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যেই এমন কিছু প্রবাদ আছে যা চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে আমাদের সমাজে। এমনই একটি প্রবাদ, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। এখন প্রশ্ন হলো কে এই গৌরী সেন? যিনি লাগা মাত্রই সবাইকে টাকা দিয়ে বেড়ান? এই নাম কি নিছক কাল্পনিক চরিত্র, না কি ইতিহাসে গৌরী সেনের অস্তিত্ব সত্যিই ছিল?

উত্তর জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েকশো বছর। তখন ১৫৮০ সাল। দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন সম্রাট আকবর। এই সময় সম্রাটের অনুমতিক্রমে ভাগীরথী নদীর তীরে এক বন্দর নগর গড়ে তোলেন শ্বেতাঙ্গ পর্তুগিজেরা। নাম দেওয়া হয় হুগলি।

এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা হতে তখনও ঢের দেরি, বাংলার বুকে পর্তুগিজরাই তখন কর্তা। সেই শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের হাত ধরেই ভাগীরথী নদীর তীরে হুগলি একটি জনপ্রিয় বন্দরে পরিণত হয়।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষে এই হুগলি শহরের অন্তর্গত বালাগ্রাম নামে এক পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন গৌরী সেন। ইতিহাসের সেই বালাগ্রাম আজ বালি বলে পরিচিত। কালক্রমে আজ তা হাওড়া জেলার অন্তর্গত। গৌরী সেনের পিতৃদত্ত নাম ছিল গৌরীশঙ্কর সেন। তার আদিনিবাস সম্পর্কে যদিও দুটি ভিন্ন মত আছে। একটি মতে তিনি অধুনা বালি শহরে জন্মগ্রহণ করেন, অন্যমত অনুযায়ী তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের মানুষ। তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকেরাই গৌরী সেনের জন্মভূমি হিসেবে বালি শহরকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।’

সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মেছিলেন গৌরী সেন। তার পূর্বপুরুষ পুরন্দর সেন সপ্তগ্রামের পতনের পর এই হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। হুগলি জেলার ব্যান্ডেল গ্রামে পর্তুগিজ মিশনারিরা তৈরি করেছিল এক উপাসনাগৃহ, যা বর্তমানে ব্যান্ডেল চার্চ নামে সুপরিচিত। এই গির্জাতেই দেওয়ান পদে চাকরি করতেন গৌরী সেন।

ভালোই কাটছিল দিন। নতুন সংসার, নতুন চাকরি। কিন্তু সব ভালো তো বেশিদিন স্থির হয় না। তাই গৌরী সেনেরও বেশিদিন ভালো থাকা হল না। ১৬৩২ সালে বাংলার বুকে মুঘল তৎপরতা বাড়ে। গির্জার অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে, চাকরি যায় গৌরী সেনের। ততদিনে দুই সন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। সংসারে এতগুলো পেট, এদিকে অন্নকষ্ট, টাকার টানাটানি। ভারী বিপদে পরেন গৌরী সেন।

অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বার হল। ঠিক করলেন বৈদেশিক বাণিজ্য শুরু করবেন। কাছাকাছি এই সমইয়েই তার সাথে পরিচয় ঘটে তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের। সমান সমান অংশীদারিতে ব্যবসা শুরু করেন দুজনে।

গোড়ার দিকে মোটামুটি ভালোই চলছিল ব্যবসা, আর এর মধ্যেই ঘটে যায় এক আশ্চর্য ঘটনা। গৌরী সেন ও তার অংশীদার দুজনে মিলে একবার এক ডুবে যাওয়া জাহাজের দস্তা নিলামে কেনেন। পরে দেখা যায়, দস্তার নীচে লুকোনো রয়েছে রূপার মোহর। দস্তার আড়ালে লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছিল বেআইনি রুপো। আচমকা এমন ধনপ্রাপ্তিকে ঈশ্বরের কৃপা হিসেবেই গ্রহণ করেন গৌরী সেন। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন গৌরী সেন। এরপর বৈষ্ণবচরণ শেঠের অনুমতি নিয়ে আলাদা ব্যবসা আরম্ভ করেন তিনি। বুদ্ধি আর পৌরুষের গুণে কালক্রমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন গৌরী সেন।

শোনা যায়, কলকাতার আহিরীটোলায় বিশাল এক প্রাসাদোপম বাড়ি করেছিলেন তিনি। গৌরী সেনের এই বিপুল অর্থলাভ নিয়েও প্রচলিত আছে নানান গল্প। এমনই এক কাহিনি থেকে জানা যায়, গৌরী সেনের পূর্বপুরুষেরা না কি চাষ করতে গিয়ে মাটির নিচে সোনার মোহর ভর্তি ঘড়া খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই সোনার ব্যবসা থেকেই তাদের লক্ষ্মীলাভের শুরু। কারণ যাই হোক না কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সামান্য ব্যবসায়ী থেকে হয়ে ওঠেন তৎকালীন বণিক সমাজের একজন বিশিষ্ট মানুষ। প্রচুর অর্থলাভের ফলে তিনি শুধু কলকাতায় নয়, গোটা বাংলার সম্ভ্রান্ত সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন।

কিন্তু কেবল দুহাতে টাকা রোজগার করেই ক্ষান্ত থাকেননি গৌরী সেন। দানবীর হিসেবেই ইতিহাসে তার আসল পরিচিতি। যেমন বিপুল পরিমাণে আয় ছিল তার, ঠিক তেমনই দুহাত ভরে খরচ করতে কার্পণ্য করতেন না। এই কারণে জীবিতকালেই কিংবদন্তি দাতা হিসেবে গোটা বাংলায় প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেনায় ডুবে রয়েছে কিংবা রাজার দরবারে বিপদে পড়েছে, এমন ব্যক্তিদের তিনি মুক্তহস্তে সাহায্য করতেন।

এ বিষয়ে সুবলচন্দ্র মিত্রের একটি প্রাচীন বাংলা অভিধানে দাতা গৌরী সেনের কার্যকলাপের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। হুগলি এলাকার সমস্ত খাবার দোকানে বলা ছিল, গৌরী সেনের নাম করে যদি কোনো গরিব অভুক্ত মানুষ খাবার চায়, তাকে যেন বিনা বাক্যব্যয়ে খেতে দেওয়া হয়। কতো গরিব ঋণগ্রস্থ মানুষ যে সেসময় গৌরী সেনের দয়ায় জীবনধারণ করত, তার লেখাজোকা নেই।

সেকালে দেনার দায়ে কারো জেল হলে ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সে মুক্তি পেত না। দেনার দায়ে অনেকের আবার জেলেই মৃত্যু হত। এ অবস্থায় গৌরী সেন ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল। তার কাছে সাহায্য চাইলে খালি হাতে ফিরতে হতো না। সে সময় তিনি অনেকেরই ঋণের টাকা পরিশোধ করে তাদের কারামুক্তির ব্যবস্থা করেন। অনেকে দেনার দায় থেকে মুক্তি পেয়েছিল তার দয়ায়।

প্রচুর মানুষ আজও বিশ্বাস করে হুগলী জেলার গৌরীশংকর শিব মন্দির গৌরী সেনের প্রতিষ্ঠিত। কলকাতার বেলগাছিয়ায় তার উত্তরসূরীর একটি বাড়ি আজও অক্ষত আছে। শোনা যায় কলকাতা মেট্রোর বেলগাছিয়া স্টেশন এই গৌরী সেনের জমির উপর দিয়ে তৈরি। বিরল স্বভাবের এই দানবীর মানুষটি মারা যান ১৬৬৭ সালে।

জীবিতকালেই মানুষের মুখে মুখে এমন প্রবাদ হয়ে ওঠা খুব কম মানুষের জীবনেই ঘটে। সে দিক থেকে আজও ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র গৌরী সেন। অর্থের অহংকার নয়, দয়া আর দানশীলতাই অমর করে রেখেছে এই ক্ষণজন্মা বাঙালিকে।