একসময়ে প্রতাপশালী ডাকাত ছিলেন, বনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকতেন। সুযোগ বুঝেই মানুষের সব কিছু লুট করে সর্বস্বান্ত করে দিতেন। এমনকি মানুষ হত্যাও করতেন, এতে তার হৃদয় বা হাত একটুও কাঁপতো না।
তার মূল নাম ছিল রত্নাকর। দস্যু রত্নাকর। পরবর্তীতে পরিচিত হয়ে ওঠেন বাল্মীকি নামে। কথিত আছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদে তিনি কবিত্বের শক্তি লাভ করেন। তাও আবার যেমন তেমন কবি নয়, রামায়ণের কবি।
রামায়ণের কবি বাল্মীকি যিনি দস্যু থেকে কবি ও সাধক হয়ে উঠেছিলেন। একজন ডাকাত বা দস্যু কীভাবে সঠিক পথের সন্ধান পেলেন, কীভাবে সাধক হয়ে উঠলেন? সরস্বতী যদি আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন তবে সেই আশীর্বাদের জন্য কেন রত্নাকরের মতো দস্যুকে বেছে নিলেন?
দস্যু রত্নাকরের কাজ ছিল ডাকাতি করে বেড়ানো, সেটাই তার আয়-উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। সেই ধারাবাহিকতায় রত্নাকর একদিন একজনকে পাকড়াও করলেন। লোকটির সঙ্গে বেশ ধন-সম্পদ ছিল। বনের ভেতর দিয়ে যে পথ চলে গেছে, সেই পথ ধরে লোকটি দূরে কোথাও যাচ্ছিল। দস্যু রত্নাকর লোকটির পিছু নিলেন। গভীর বনে প্রবেশের পরেই রত্নাকর তার উপরে আক্রমণ করে সব টাকা-পয়সা কেড়ে নিলেন। তবে লোকটির কপাল ভালো যে রত্নাকর তাকে তখনই হত্যা করে ফেলেনি। কিন্তু তার মানে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এমনটা নয়।
টাকা-পয়সা নিয়ে নেওয়ার পরে এখন লোকটিকে হত্যা করার পালা। তাহলে আর কেউ এই লুটপাটের খবর জানতে পারবে না। রত্নাকর হত্যার জন্য যখন সব প্রস্তুতি সেরে নিলেন ঠিক এমন সময় লোকটি মরিয়া হয়ে রত্নাকরকে অভিশাপ দিয়ে বলে উঠল, ‘শয়তান তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি। পাপ-পুণ্যের কোনো জ্ঞান নেই তোর? আমি ব্রাহ্মণ। আর আমাকেই তুই মেরে ফেলতে চাস? আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, তুই নরকে যাবি।’
নরকের ভয় সম্ভবত দস্যুদেরও থাকে! আবার তাদের নিজস্ব কতক যুক্তি-তর্কও থাকে। এজন্যই হয়ত ডাকাত রত্নাকর তখন বলে উঠলো, ‘কেন আমি নরকে যাব? আমি তো এই টাকা দিয়ে আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিবার ও সন্তানদের আহারের ব্যবস্থা করি। আমি তো পুণ্য কাজই করেছি! আমি নরকে যাব কোন যুক্তিতে? আমি শুধুমাত্র ডাকাতিই জানি, তাই সেটাই করছি। অন্য কোনো কাজ জানলে সেটাই করতাম। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য যতসব অজুহাত দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছ! এসব বাদ দিয়ে মরার জন্য তৈরি হও।’
হতভাগ্য লোকটি তখন বলল, ‘তুই যে ডাকাতি করিস, নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলে তাদের সব সহায়-সম্পদ কেড়ে নিস, তোর বাড়ির সবাই তা জানে?’
রত্নাকর জবাব দিল, ‘তারা তা জানবে কী করে? আমি কি তাদের এসব বলি নাকি?’
লোকটি তখন বললো, ‘তুই বাড়িতে গিয়ে তোর বাড়ির সবাইকে তোর এই ডাকতি পেশার কথা বলবি। আর তাদের দুটি কথা জিজ্ঞাস করবি। প্রথম কথা হলো, তোর এই কাজটা অর্থাৎ মানুষ মেরে সম্পদ লুট করা ভালো নাকি মন্দ কাজ। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমাদের মেরে ও সম্পদ লুট করে তুই যে এত পাপ কামাই করছিস, তার ভাগ তোর আত্মীয়-স্বজন নেবে কি?’
ডাকাত রত্নাকর লোকটির এই কথায় মনে মনে কিছুটা ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়ল। খানিকটা সময় ভেবেচিন্তে রত্নাকর লোকটিকে বললো,‘আচ্ছা! ঠিক আছে, তোমার কথাই হবে, আমি বাড়িতে যাচ্ছি। তবে ব্যাটা বামুন, আমি তোকে এখানেই বেঁধে রেখে যাব। তুমি আমাকে বোকা ভেবেছ, তাই না? আমি বাড়িতে গেলেই তুমি ফাঁকতলে পালিয়ে যাবে? না, সেটা হচ্ছে না।’
এই কথা বলে লোকটিকে একটি শক্ত দড়ি দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে সে বাড়ির দিকে গেল।
বাড়িতে গিয়ে সবাইকে একসঙ্গে ডেকে বললো, ‘আমি তো তোমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য পেশা হিসেবে ডাকতি করে থাকি, আমার এই কাজটি ভাল না মন্দ?’
সাথে সাথেই সারা বাড়িতে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে গেল! কেউবা কান্নাকাটি, কেউবা গালাগালিতে মত্ত হয়ে উঠল! রত্নাকরের পিতা-মাতা তাকে অভিশাপ দিতে লাগল। রত্নাকরকে তারা দুষতে লাগল পাপের অন্ন না জেনে এতকাল গ্রহণ করেছে বিধায়। স্ত্রীও তার শ্বশুর-শাশুড়ির দলে যোগ দিল। সে-ও স্বামীকে গালাগালি করতে থাকল। ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। এক মুহূর্তই যেন সব ওলটপালট হয়ে গেল!
পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে রত্নাকর এবার তাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা যা হবার তা তো হয়েই গেছে, খেয়ে-পরে বেঁচেও তো থাকতে হবে! এবার বলো, এতে যদি কোনো পাপ হয়েই থাকে, তবে তার ভাগ তো তোমরাও নেবে, নাকি? তোমাদের খাওয়া-দাওয়া দেওয়ার জন্যই তো আমি এসব করে থাকি।’
এবার তো যেন কুরুক্ষেত্র! উতপ্ত তেলের কড়াইয়ে পানির ছিটা! বাবা-মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী বললি! তোর পাপের বোঝা আমরা কেন বহন করব? আমরা কি ডাকতি করে বেড়াই? আমরা কি তোকে ডাকাত হতে বলছিলাম? এই মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা!’
স্ত্রীও সেই একই কথা বলল। ছেলেমেয়েরা বয়সে ছোট। তারা পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক সম্পর্কে খুব একটা বোঝে না। তবুও তারা আগের মতোই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। এতক্ষণ মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়লো ডাকাত রত্নাকরের। সে বুঝতে পারল, মরার পর অনন্তকাল তাকে নরকে পুড়ে মরতে হবে। ভুল বুঝতে পেরে সে এবার কাঁদতে কাঁদতে ছুটল তার সেই ডাকাতির আস্তানায়, গভীর বনে, যেখানে লোকটিকে রত্নাকর বেধে রেখে এসেছিল। গিয়েই লোকটিকে ছেড়ে দিল, সহায়-সম্পদ ফেরত দিয়ে দিল।
এবার তার পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঠাকুর, এখন আমার কী হবে? আমার পাপের ভাগ তো কেউ নেবে না। এখন আমি কী করব? আমাকে রক্ষা করুন!’
লোকটি তখন ডাকাত রত্নাকরকে বললো, ‘প্রতিজ্ঞা কর, এখন থেকে তুই আর ডাকাতি করবি না। মানুষ হত্যা করবি না, মানুষের সম্পদ লুট করবি না। আর এই গাছের নিচে বসে বসে তপস্যা করবি।’
রত্নাকর জবাবে বললো,‘তপস্যা আবার কী জিনিস ঠাকুর?’
লোকটি জবাব দিল, ‘তুই গাছের নিচে বসে চোখ বন্ধ করে কেবল রাম-রাম বলতে থাকবি। শুধু এই একটা নামই তুই বলতে থাকবি। উনি পুণ্যবান লোক। তার নাম জপতে জপতে এক সময়ে দেখবি তোর পাপ মোচন হয়ে গেছে। যা বলেছি তা-ই কর।’
উপদেশ দিয়ে লোকটি চলে গেল। দস্যু রত্নাকর এবার গাছের নিচে ধ্যানে বসল। কিন্তু এতবড় পাপী এত সহজেই ক্ষমা পেয়ে যাবে তা তো হয় না। রত্নাকর তার মুখ থেকে ‘রাম-রাম’ শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। তার মুখ দিয়ে রামের পবিত্র নাম বের হচ্ছে না। সে বলতে চাইছে রাম, কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে মরা-মরা। কাঁদতে কাঁদতে সে দৌড়ে ব্রাহ্মণের কাছে যেতে থাকলো, তাকে পেয়ে এই অবস্থার কথা বললো। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ বলল, ‘তা হলে তুই এখন বোঝ তোর পাপের পরিমাণ কতখানি? কী আর করবি এখন! ঠিক আছে, তুই এখন মরা-মরাই বলতে থাক, বলতে বলতে একসময় তোর মুখ থেকে রাম-রাম উচ্চারণই বের হবে।’
রত্নাকর সেভাবেই ধ্যান শুরু করল। এক ধ্যানেই কেটে গেল বহুকাল। মরার বদলে মুখে আসল রাম। তবুও তার ধ্যান ভাঙ্গল না। লোকজন তাই ধীরে ধীরে রত্নাকর ডাকাতের নামই ভুলে গেল।
একদিন এক পথিক রত্নাকরের ধ্যানমগ্ন সেই বনের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। হঠাৎ এক জায়গায় এসে লোকটি থমকে দাঁড়ালো। কী যেন একটা পরিচিত শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে অস্পষ্ট। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল সে। এ তো রাম রাম শব্দ! কোথা থেকে এই শব্দ আসছে? এত গভীর বনের মধ্যে? চারিদিকে তাকিয়ে কোথাও কোনো লোকজন দেখতে পেল না সে। তাহলে আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে? আশেপাশে কেবলই তো গাছপালা, লতাপাতা আর বনজঙ্গল। শব্দটা তো খুব বেশি দূর থেকেও আসছে না মনে হচ্ছে! তাহলে কোথা থেকে আসছে? লোকটি হন্য হয়ে খুঁজতে লাগল।
কাছেই পথের পাশে একটা উইঢিবি দেখতে পেল সে। ওর ভেতর থেকেই কি শব্দটা আসছে নাকি? অবিশ্বাস্য! পথিক কাছে গিয়ে ঢিবির গায়ে কান পাতল। তাই তো! শব্দ তো উইঢিবির ভেতর থেকেই আসছে! ঢিবির মধ্যে মানুষ নাকি? পথিক অদম্য কৌতূহলে লাঠি দিয়ে খুব সাবধানে উইঢিবি ভাঙতে লাগলো। আশ্চর্য! ভেতরে একটি বুড়ো লোক দেখা যাচ্ছে! তার চুল, দাড়ি, গোঁফ সব পেকে ধবধবে হয়ে গেছে। লোকটি চোখ বন্ধ করে আছে আর মুখ থেকে শুধু রাম উচ্চারণ!
লোকটি তখন জানতো না, এই হলো সেই লোক, যার নাম ছিল রত্নাকর। কারণ রত্নাকরের নাম তখন সবাই ভুলে গেছে। তবে বুঝতে পারল এই লোকটি কোন এক মহান সাধক হবেন। সন্ন্যাসী হবেন। অতঃপর সন্নাসীকে উইঢিবি ভেঙে বের করা হলো। উইঢিবির আরেক নাম বাল্মীক আর সেই অনুসারে তার নতুন নাম হয়ে গেল বাল্মীকি। বাল্মীক থেকে বের করা হয়েছে বলেই বাল্মীকি।
মানুষ হয়ত তখনও বুঝতে পারেনি এই বাল্মীকিই পরে মুখে মুখে রামায়ণ গান বানাবেন, সেই গান গেয়ে শোনাবেন জনসাধারণকে। অশিক্ষিত, ডাকাত, দস্যু, ধ্যান করতে করতে সন্ন্যাসীই না হয় হয়েছে, কিন্তু তাই বলে মহাকাব্য তৈরি করবেন? তা-ও আবার রামায়ণ? রহস্য সেখানেও!
একদিন সন্ন্যাসী বনের মধ্যে পায়চারি করছেন। কাছেই একটা গাছের ডালে একটা ক্রৌঞ্চ আর তার বৌ ক্রৌঞ্চী বসে আছে, গল্প করছে। ক্রৌঞ্চ হলো কোঁচবক। হঠাৎ কোত্থেকে একটা তীর এসে ক্রৌঞ্চের বুকে বিঁধে গেল, সে মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে মরে গেল। আর তার ক্রৌঞ্চী বৌয়ের সে কী কান্না তার পাশ ঘুরে ঘুরে। দুঃখ কষ্টে বুক ভেঙে যেতে লাগল বাল্মীকির। হঠাৎ তার অজান্তেই তার মুখ থেকে ছন্দোবদ্ধ পদ্য বেরিয়ে এল, যার অর্থ-‘ওরে ব্যাধ, তুই এমন সর্বানাশা খারাপ কাজ করলি? জীবনে তোর কোনো উন্নতি হবে না।’ বাল্মীকি নিজেই শিউরে উঠলেন নিজের কথা শুনে, ভয়ে, বিস্ময়ে। এ কেমন করে হলো! তিনি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কাব্যগান কী করে বেরুল তার মুখ দিয়ে! বুঝলেন, কাব্যের দেবী, বিদ্যার দেবী, মা সরস্বতীর আশীর্বাদেই শুধু এমন অসম্ভব সম্ভব হতে পারে এবং সেটাই হয়েছে।
এভাবেই ডাকাত বা দস্যু রত্নাকর হয়ে উঠলেন একজন সাধক। হয়ে উঠলেন রামায়ণের মহাকবি বাল্মীকি। সেই থেকে তার অমর গ্রন্থখানি পাঠ হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে। হয়ত এই পাঠ চলতে থাকবে পৃথিবীর সমাপনীকাল পর্যন্ত।
একসময়ের বিখ্যাত দস্যু, ডাকাত বা খারাপ লোক রত্নাকর ধ্যান করে পরিণত হয়ে গেলেন মহাকবি বাল্মীকিতে। রচনা করলেন রামায়ণের মতো মহাকাব্য। খারাপ মানুষও শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর হয়ে উঠতে পারেন, যদি বিধাতা তার উপরে দয়া করেন। ঠিক এরই যেন যথার্থ উদাহরণ বাল্মীকি।