ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কোন্দল ও বিতর্ক শেষে অবশেষে একটি জায়গায় পৌঁছেছে আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তালেবান। মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে প্রধান করে আফগানিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণা করেছে কট্টর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এই ঘোষণা দেন। আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যম তোলো নিউজ এই তথ্য জানিয়েছে।
তোলো নিউজ জানিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নতুন সরকারের নেতৃত্ব দেবেন ওসামা বিন লাদেনের সাবেক দেহরক্ষী ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ। পাশাপাশি তার প্রথম ডেপুটি হিসেবে কাজ করবেন তালেবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল গনি বারাদার।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর এক টুইট বার্তায় তোলো নিউজ তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৫ শীর্ষ ব্যক্তির নাম প্রকাশ করে। তারা লেখে- সরকার প্রধান মোল্লা হাসান আখুন্দ, সহকারী প্রধান (প্রথম) মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার, সহকারী প্রধান (দ্বিতীয়) মৌলভী হান্নাফি, ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব, ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি।
মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ তালেবানের আগের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি দুই দশক ধরে তালেবানের প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী পরিষদ ‘রেহবারি শুরা’ বা নীতি-নির্ধারণী পরিষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেন হামলার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
এদিকে তালেবানের এ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ক্বারি দ্বীন হানিফ। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন আমির খান মুত্তাকি।
রাষ্ট্রপ্রধান ও তার দুই সহকারীর পর গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রণালয় হচ্ছে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুব প্রতিরক্ষা এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে।
সিরাজউদ্দিন হাক্কানির মাথার জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার বহু আগেই ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই দশক আফগানিস্তানের ভেতরে অনেক সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী হাক্কানি নেটওয়ার্ককে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে।
সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের ‘মুজাহিদীন’ নেতা জালালুদ্দিন হাক্কানির ছেলে সিরাজউদ্দিন হাক্কানি একইসঙ্গে তালেবানের উপপ্রধান আবার হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান। তালেবানের অংশ হাক্কানি নেটওয়ার্ক তালেবানের চেয়ে বেশি চরমপন্থী।
ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের ছেলে ৩০ বছর বয়সী মোল্লা ইয়াকুব তালেবানের উপপ্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি এতদিন তালেবান বাহিনীর সামরিক শাখার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
তালেবানের যুদ্ধের কৌশল ঠিক করা ও অভিযান পরিচালনার নেতৃত্ব দিতেন তিনি। প্রয়াত বাবার কারণে তালেবানে শ্রদ্ধার পাত্র মোল্লা ইয়াকুব। যে কারণে তালেবানের মধ্যে কোনো বিভেদ কিংবা কোন্দলের সময় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান তিনি।
এদিকে নতুন সরকারের আরও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে তালেবান।
নতুন সরকারের ভারপ্রাপ্ত গ্রামীণ পুনর্বাসন ও উন্নয়ন মন্ত্রী হয়েছেন মোল্লা মোহাম্মদ ইউনুস আখুন্দজাদা, ভারপ্রাপ্ত গণপূর্ত মন্ত্রী মোল্লা আব্দুল মান্নান ওমারি, ভারপ্রাপ্ত খনি ও জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ ঈসা আখুন্দ, ভারপ্রাপ্ত হজ ও ধর্মমন্ত্রী মৌলভী নূর মোহাম্মদ সাদিক, ভারপ্রাপ্ত বিচারমন্ত্রী মৌলভী আব্দুল হাকিম শারিয়ে, সীমান্ত ও আদিবাসী বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোল্লা নূরুল্লাহ নূরী, শরণার্থী বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী খলিলুররহমান হাক্কানি, দাওয়াত-উ-এরশাদ বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ খালিদ।
এ ছাড়া সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছেন মোল্লা মোহাম্মদ ফাজিল, সহকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী নূর জালাল, সহকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (মাদক নিয়ন্ত্রণ) মোল্লা আব্দুলহক, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই। এছাড়া সহকারী তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ।
সেনাপ্রধান হয়েছেন কারি ফাশিউদ্দিন। ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুল হক ওয়াসি। গোয়েন্দা বিভাগের প্রথম সহকারী প্রধান মোল্লা তাজমির জাভেদ এবং প্রশাসনিক সহকারী প্রধান মোল্লা রহমতুল্লাহ নাজীব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিস, প্রেসিডেন্টের প্রশাসনিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আহমাদ জান আহমাদি।
তিন সপ্তাহ আগে আফগানিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কয়েক দফা সরকার ঘোষণা স্থগিতের পর মঙ্গলবার তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা জানি আমাদের দেশের মানুষ নতুন একটি সরকারের জন্য অপেক্ষা করছিল।’
তালেবান প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এর আগে মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে আফগানিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান এবং মোল্লা বারাদার ও মোল্লা আব্দুস সালামকে তার ডেপুটি হিসেবে মনোনীত করেন। এরপরই সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তালেবান প্রধান আখুনজাদা ধর্মীয় বিষয় ও ইসলামি বিধিবিধান অনুযায়ী প্রশাসন পরিচালনার বিষয়ে নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা নীতি নির্ধারক হিসেবে থাকবেন। কোনো পদে না থাকলেও নতুন সরকারে তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
তালেবান অবশ্য সরকার ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারপ্রাপ্ত, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছিল। পূর্বে ঘোষিত চার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সরকার গঠনের আগেই তালেবান যে চার মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছিল এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী ছিলেন গুল আগা, ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সদর ইব্রাহিম, ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা আবদুল কাইয়ুম জাকির ও ভারপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী আবদুল বাকি হাক্কানি।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা তালেবান মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর হাতে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত অনির্বাচিত পরিষদের মাধ্যমে কঠোর শরিয়া আইনে আফগানিস্তান শাসন করলেও এবার নমনীয় হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের এমন আশ্বাসে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও যে কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা নির্ভর করবে ক্ষমতায় আসার পর তালেবান কী করে তা দেখার ওপর।