বিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম লেখক উইলিয়াম ফকনার। তার জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যে ১৮৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এবং মৃত্যু ১৯৬২ সালের ৬ জুলাই। ১৯৫৬ সালে দ্য প্যারিস রিভিউতে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে জাঁ স্টাইন। সেই সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য তথ্যের আলোকে তার অন্তর্জগতে প্রবেশের চেষ্টা আমাদের।
লেখক হিসেবে নিজেকে কীভাবে দেখেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি না থাকলে অন্য কেউ তার লেখাগুলো লিখতেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন শেক্সপিয়ার, বালজাক, হোমার এরা সবাই একই বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তারা হাজার বছর বেঁচে থাকলে প্রকাশকদের আর লেখক লাগতো না। তার এই বক্তব্য ক্ল্যাসিক সাহিত্য সম্পর্কে মেনে নেয়া গেলেও আধুনিক কালের লেখকের ক্ষেত্রে বলা যায় না। জাঁ স্টাইনের ওই সাক্ষাৎকারে তিনি তার স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করতেও ছাড়েননি। অপরদিকে তিনি বিশ্বাস করেন ভালো ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য শতকরা নিরানব্বই ভাগ মেধা, নিরানব্বই ভাগ নিয়মানুবর্তিতা, নিরানব্বই ভাগ পরিশ্রম করতে হয়।
তবে তিনি লেখককে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে না করেছেন। তিনি মনে করেন একজন লেখক নিজের কাজ ঠিক মতো করার জন্য অন্যের মূল্যবান রত্ন ছিনিয়ে নেবেন, চুরি করবেন, ধার করবেন কিংবা ভিক্ষা করে নেবেন—তাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি নীতিহীন হতেই পারেন। এই রত্ন বলতে তিনি টিএস এলিয়টের মতো সমস্ত শিল্পকলাকেই বুঝিয়েছেন।
লেখকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তিনি বলেন, লেখকের দরকার হলো পেন্সিল আর কাগজ। ভালো লেখক সফলতা কিংবা ধন-সম্পদ লাভের চিন্তা করেন না। তিনি মনে করেন একজন ভালো লেখক কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কিছু চান না, তিনি ব্যস্ত থাকেন তার লেখার কাজে। আপোশহীন এমন লেখককে কেবল টলাতে পারে মৃত্যু। লেখকের দায়বদ্ধতা শুধু তার শিল্পের প্রতি। সুখ-শান্তি আর সন্তুষ্টির সাথে শিল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আমার কাজের জন্য চাই কাগজ, তামাক, খাবার আর অল্প একটু হুইস্কি।’ তিনি শুধু অর্থই নয়, ক্ষমতাবানদের সঙ্গও প্রত্যাখ্যান করতেন। ১৯৬২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি দেশের সব নোবেল বিজয়ীকে হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ করেন। প্রায় সবাই সেই ভোজে অংশগ্রহণ করলেও ফকনার যাননি। কেন যাননি এই উত্তরে তিনি বলেন, ‘একবেলা খাওয়ার জন্য ৬০ মাইল পাথ ভাঙা কি ঠিক?’
লেখক কি কৌশল অবলম্বন করবেন? ‘না তাহলে তাকে শল্যবিদ কিংবা রাজমিস্ত্রির কাজ বেছে নিতে দেয়া উচিত।’ কোনো তত্ত্ব অনুসরণ করবেন? ‘করলে তিনি বোকামিই করবেন। নিজেকে পাকাপোক্ত করতে নিজের ভুলের ভেতর দিয়েই যেতে হবে।’
লেখার উপাদান কীভাবে সংগ্রহ করতে হয়? ‘লেখকের তিনটি জিনিসের প্রয়োজন : অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং কল্পনা। এগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি থাকলে বাকিটার কাজ চলে যেতে পারে। আবার কখনো একটা থাকলেও অন্য দুটোর কাজ চালিয়ে নেয়া যেতে পারে।’
ফকনারের ব্যাপারে দুর্বোধ্যতার কথা তো আছেই। পাঠক তার লেখা বুঝতে না পাড়লে এমনকি দু-তিন প্রয়াসেও বুঝতে না পারলে কী করবেন– এই প্রশ্নের জবাবে তার সোজা সাপ্টা জবাব ‘চার বার পড়ুন।’
লা রোশফুকো যেমন প্রেমকে ভূতের সঙ্গে তুলনা করেছেন, মানে আমরা ভূতকে বিশ্বাস করি কিন্তু বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। তেমনি ফকনার লেখকের অনুপ্রেরণাকে বলেন ‘আমি অনুপ্রেরণার কথা শুনেছি, কিন্তু দেখিনি।’
লেখালেখি শুরুর গল্পটি বলবেন? ‘আমি তখন নিউ অরলিন্সে থাকতাম। …তখন দেখা হলো শেরউড এন্ডারসনের সঙ্গে। …দুপুরের আগে তাঁকে কোনো দিন বাইরে দেখিনি। সে সময়টাতে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়িতে বসে লেখালেখি করতেন। …তাঁর জীবন যাপন দেখে আমার মনে হলো, লেখকের জীবন যদি এমনই হয় তাহলে তো আমিও এ জীবন বেছে নিতে পারি। সুতরাং আমার প্রথম বই লেখার কাজ শুরু করে দিলাম। …মি. এন্ডারসনের সঙ্গে যে আমার তিন সপ্তাহ দেখা হয় না সে কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। শেষে তিনি নিজেই একদিন চলে এলেন আমার দরজায়। বললেন, ব্যাপার কী? তুমি কি আমার ওপর খেপে আছ? আমি বললাম, আমি একটা বই লেখার কাজ শুরু করেছি। তিনি শুধু বললেন, মাই গড! এ বলেই হাঁটা দিলেন বাইরের দিকে। …বইটা শেষ করার পর রাস্তায় একদিন মিসেস এন্ডারসনের সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বই লেখার কাজ কেমন চলছে? আমি বললাম, লেখা তো শেষ। মিসেস শেরউড আরো বললো, …তোমার পাণ্ডুলিপি যদি তাকে পড়তে না হয় তাহলে সে তার প্রকাশকের সাথে কথা বলবে তোমার পাণ্ডুলিপি যাতে তিনি গ্রহণ করেন। …ব্যস, এভাবেই লেখক হয়ে গেলাম।’
লেখকরা তাদের সমসাময়িকদের লেখা পড়েন না, এমন একটি অভিযোগ সবসময়ই উত্থাপিত হয়। উইলিয়াম ফকনার সরাসরিই ‘না’ বলেন। তিনি পড়েন না। তিনি পড়েন সেইসব লেখকদের বই যাদের নাম তিনি ছেলেবেলায় শুনেছেন। তার এই তালিকায় আছে: ওল্ড টেস্টামেন্ট, ডিকেন্স, কনরাড, সারভান্তেস, দোন কিহোতে, ফ্লবেয়ার পড়ি, বালজাক, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, শেক্সপিয়ার, মেলভিল; কবিদের মধ্যে মার্লো, ক্যামপিওন, জনসন, হেরিক, ডান, কিটস, শেলির কবিতা।
উইলিয়াম ফকনার নিজের নামের বানান ভুল লিখতেন। এই ভুল ইচ্ছাকৃত ছিলো না। তার পিতা ও প্রপিতামহ Falkner লিখতেন, কিন্তু তিনি লিখতেন Faulkne, শোনা যায় জীবনে প্রথম টাইপ করার সময় নিজেই এই ভুলটি করেছেন, যা আর কোনো দিন ঠিক করেননি। তবে এই ভুলটি পেছনে অন্য রহস্যও আছে, তার প্রপিতামহ কর্নেল ফকনার ইউ যোগ করে আগে লিখতেন, কিন্তু দেখতে খারাপ লাগায় তিনি তা পারিহার করেন।
ফকনার ছিলেন ধূমপায়ী। সারা জীবন তিনি একই উপহার গ্রহণ করতেন। ধবধবে সাদা পাইপ ক্লিনার ছিল তার অসম্ভব প্রিয়। বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রির সঙ্গে ঝুলতো সাদাসহ নানান রঙের পাইপ ক্লিনার। আর অন্যসব উপহার তিনি প্যাকেট খুলেও দেখতেন না।
ফকনার শিক্ষাজীবনে হাইস্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। তবে ‘বিশেষ ছাত্র’ হিসেবে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, তবে সেখানকার লেখাপড়াও শেষ করতে পারেননি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রয়াল এয়ার ফোর্সের কানাডীয় শাখায় স্বল্প সময়ের জন্য যোগ দেন। এর আগে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে কম ওজন ও উচ্চতার কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তবে যুদ্ধে অংশ নেবার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর তিনি কেরানিগিরি ও বাড়ি নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
ফকনারের লেখক জীবন শুরু হয় কবিতা দিয়ে। যার কিছু প্রকাশিতও হয়। ১৯২১ সালে তার লেখা একটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। ১৯২৪ সালে প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে তার সাথে শেরউড অ্যান্ডারসনের সাক্ষাৎ হয়। অ্যান্ডারসনের প্রভাবে তিনি কল্পকাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৩০ ও ১৯৪০—এর দশকের শুরুর দিকে ফকনার চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে হলিউড গিয়েছিলেন। জীবনের বাকী সময় তিনি অক্সফোর্ডেই গল্প ও উপন্যাস লিখে কাটিয়ে দেন।
ফকনারের পূর্বপুরুষ আঠারো শতকে স্কটল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আসেন। প্রপিতামহ উইলিয়াম ক্লার্ক ফকনার ছিলেন তরুণ লেখক ফকনারের প্রেরণার বীজ। উইলিয়াম ক্লার্ক মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় কর্নেল ছিলেন। তিনি রেলপথ নির্মাণ করেন এবং ১৮৮১ সালে ‘দ্য হোয়াইট রোজ অভ মেমফিস’ নামে একটি জনপ্রিয় রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন।
ফকনার মোট ১৯টি উপন্যাস ও বহু ছোট গল্প লেখেন। তার বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থও আছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি (১৯২৯), অ্যাজ আই লে ডাইং (১৯৩০), লাইট ইন অগাস্ট (১৯৩২), আবসালোম, আবসালোম! (১৯৩৬), এবং দি আনভ্যাংকুইশ্ড (১৯৩৮)। ১৯৪৯ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে ‘আ ফেবল’ নামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন ফ্রান্সের উপর লেখা উপন্যাসটির জন্য জাতীয় বই পুরস্কার এবং পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।
এক পর্যায়ে ফকনারের স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভগ্ন হতে থাকে এবং বেশ কয়েকবার ঘোড়া থেকে পড়ে আঘাত পান। এমনই এক আঘাতের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর হার্ট অ্যাটাকে ১৯৬২ সালের ৬ জুলাই তিনি মারা যান।