ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবল মানেই সৃজনশীলতার ঝংকার আর সৌন্দর্যের মাদকতা। ফুটবলের যেকোনো মঞ্চে, যেকোনো প্রান্তে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই তৈরি করে ঐন্দ্রজালিক মৌতাত। মারাকানায় রবিবার ভোর ৬টায় কোপার ফাইনালে সেটা আরো বেশি। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির এখনো দেশের জার্সিতে জেতা হয়নি কোনো শিরোপা। তাঁকে একটা শিরোপার স্বাদ দিতে মুখিয়ে পুরো আর্জেন্টিনা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ব্রাজিল কখনো নিজেদের মাটিতে কোপার ফাইনাল হারেনি। এবারও মেসির স্বপ্ন ভাঙার হুংকার ব্রাজিলিয়ান সেন্টারব্যাক মার্কিনোসের, ‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার লড়াই সাধারণ একটা ফুটবল ম্যাচের চেয়ে বেশি কিছু। দুই দলের ম্যাচের সময় থমকে যায় পৃথিবী। আমরা মেসিকে ওর লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করব। তা ছাড়া শুধু মেসির দিকে মনোযোগ দিতে পারি না, কারণ তখন অন্যরা ব্যবধান গড়ে দিতে পারে।’
একই সময়ে শুরু হওয়া ইউরোর ম্যাচগুলো হয়েছে ভরা গ্যালারিতে। সেখানে করোনার থাবায় লণ্ডভণ্ড ব্রাজিলের গ্যালারি দর্শকহীন। তবে ফাইনালে অনুমতি আছে ছয় হাজার ৫০০ দর্শক মাঠে আসার। মাঠগুলোও নিম্নমানের। এ নিয়ে অভিযোগ করে জরিমানা গুনেছেন খোদ ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতে। সব সমালোচনা পেছনে ফেলে রিও ডি জেনেইরোর মারাকানার ক্যানভাসে অপূর্ব ফুটবলের ছবিই আঁকতে চাইবেন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। গত আসরের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারানোটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে তাঁদের। চোটে পড়া নেইমার ছাড়াই ২-০ গোলে জিতেছিল তিতের দল। এবারের আসরে ২ গোল আর ৩ অ্যাসিস্ট করে নেইমার জানিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম কোপার জন্য তিনি প্রস্তুত। ৪ গোল আর ৫ অ্যাসিস্টে মেসিও দাবি জানিয়ে রেখেছেন শিরোপার। দুই প্রিয় বন্ধুর লড়াইটাও তাই দেবে ভিন্নমাত্রা। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে মেসির একটি শিরোপা চান কিছু ব্রাজিলিয়ানও! নেইমার সেটা মানতে না পেরে ইনস্টাগ্রামে যেভাবে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাতেই স্পষ্ট ফাইনালে কোনো বন্ধুত্ব থাকবে না দুজনের।
লিওনেল স্কালোনির হাত ধরে আর্জেন্টিনা অপরাজিত টানা ১৯ ম্যাচ। তিতের ব্রাজিলও হারেনি টানা ১৩ ম্যাচ। দুই দলের খেলোয়াড়রা দুর্দান্ত ছন্দে থাকাতেই সম্ভব হয়েছে এটা। প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা জেনে ফাইনালের একাদশ গড়তে অবশ্য হিমশিমই খাওয়ার কথা দুই দলের কোচের। কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে গোল হজম করেননি ব্রাজিলের ম্যানসিটি গোলরক্ষক এদেরসন। ফাইনালেও কি তিতে আস্থা রাখবেন তাঁর ওপর। নাকি ফেরাবেন সবচেয়ে দামি গোলরক্ষক আলিসন বাকেরকে? ব্রাজিলের রাইটব্যাক দানিলোর জায়গা পাকা হলেও লেফটব্যাকে রেনান লোদির সঙ্গে লড়াই অ্যালেক্স সান্দ্রোর। সেন্টারব্যাকে মার্কিনোসের সঙ্গী হিসেবে রিয়ালের এদের মিলিতাও নাকি চেলসির ৩৭ বছর বয়সী থিয়াগো সিলভা—জানা যাবে ফাইনালেই। ৪-২-৩-১ ছকে খেলা ব্রাজিলের মাঝমাঠে কাসেমিরো, ফ্রেদ। তার সামনে নেইমার, পাকুয়েতা, এভারতন। আর একমাত্র ফরোয়ার্ড রিচার্লিসন।
৪-৩-৩ ছকে খেলা আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে এমিলিয়ানো মার্তিনেজের বিকল্প নেই। সেমিফাইনালে তিনটি শট ঠেকিয়ে তিনি এখন আর্জেন্টাইন নতুন বীর। সেন্টারব্যাক হিসেবে ভরসা হতে পারতেন ক্রিস্তিয়ান রোমেরো। আতালান্তার এই তরুণ ইনজুরির জন্য বেঞ্চেও ছিলেন না সেমিফাইনালে। তবে গতকাল দলের সঙ্গে অনুশীলন করায় আশা শেষ হয়ে যায়নি রোমেরোর। তিনি না থাকলে জার্মান পেজ্জেল্লার সঙ্গে নিকোলাস ওতামেন্দি থাকবেন রক্ষণের দেয়াল হয়ে। রাইটব্যাক মোলিনা আর লেফটব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন তাগলিয়াফিকোই। মাঝমাঠে দি পল, পারেদেস আর লো সেলসোর জায়গাটা পাকা। আক্রমণে মেসি, মার্তিনেজের সঙ্গী হতে পারেন নিকোলাস গনজালেজ। পুরো ফিট থাকলে দি মারিয়াকেও একাদশে রাখতে পারেন স্কালোনি। সেমিফাইনালে রক্তাক্ত হওয়া মেসি আজ শতভাগ ফিট হয়ে খেলতে পারবেন কি না, শঙ্কা আছে তা নিয়েও।
মেসিকে ঘিরে মুগ্ধতা আছে খোদ ব্রাজিলিয়ান শিবিরে। গত কোপার সেমিফাইনালের আগে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছিলেন থিয়াগো সিলভা। কাসেমিরোও প্রশংসা করেন মেসির। তবে ফাইনালে মাঝমাঠে মেসির জাদু আটকে দেওয়ার দায়িত্বটা কাসেমিরোরই। রিয়ালের হয়ে ‘এল ক্লাসিকো’য় অনেকবার মেসিকে থামিয়েছেন তিনি। মারাকানাতেও মেসি মায়াজাল বিছাতে না দিতে কাসেমিরোকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে একটা পরিসংখ্যান, ব্রাজিলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ২৭ ম্যাচের একটিও হারেননি কাসেমিরো। মেসিও চারটি মর্যাদার টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলে হতাশ করেছেন প্রতিবার। ২০০৭, ২০১৫ ও ২০১৬ কোপার ফাইনালে গোল পাননি। এমনকি ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালেও গোলহীন তিনি। ব্যর্থতার তালাটা খোলার চাবি এবারের ফাইনালে পাবেন তো আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি?
একাদশ যেমনই হোক ফাইনালে কেউ কাউকে ছাড়বে না এক ইঞ্চি জমিও। এর আগে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চারটি ফাইনাল সে কথাই বলছে। কোপা আমেরিকায় ১৯৩৭ সালে প্রথম ফাইনালে ব্রাজিলকে ২-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। এরপর পেরুতে ২০০৪ সালের ফাইনালে ২-২ সমতার পর টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে জেতে ব্রাজিল। ২০০৭ সালে ভেনিজুয়েলায় হওয়া ফাইনালে ব্রাজিলের দাপট ৩-০ গোলে। মর্যাদার টুর্নামেন্টে এ ছাড়া শুধু ২০০৫ সালের ফিফা কনফেডারেশনস কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। আদ্রিয়ানোর জোড়া গোল আর কাকা, রোনালদিনহোর লক্ষ্যভেদে ৪-১ ব্যবধানের সহজ জয় সেলেসাওদের। এবারের ফাইনালে শেষ হাসি হাসবে কারা? ১৯৯৩ সালের পর কোন শিরোপা জেতেনি আর্জেন্টিনা। এজন্য তাদের পিছিয়ে রাখছেন না ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতে,‘ ওটা অতীত। ইতিহাস দিয়ে কোন কিছু বিচার করা যায় না। ফাইনালের ৯০ মিনিটের পরই বলা যাবে শিরোপার দাবীদার কারা।’
লাতিন অঞ্চলের দেশগুলোর নেতাদের এক বৈঠকে ব্রাজিলিয়ান প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘ব্রাজিল ম্যাচটা জিতবে ৫-০ গোলে।’ আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের দিকে রসিকতা করে দেখিয়েছেন পাঁচ আঙুলও। জবাবে কিছু না বলে শুধু হেসেছেন ফার্নান্দেজ। জবাবটা কি আজ মাঠেই দেবে আর্জেন্টিনা?