সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, আমাদের দাবি পূরণে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা তাদের ওপর আস্থা রেখে আপাতত আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা আগামীকাল থেকে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক করে ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর আহ্বান জানাচ্ছি।
এর আগে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সিলেট সার্কিট হাউসে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও সেখানে ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে টানা তিন ঘণ্টা বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আচার্য যেহেতু একজন উপাচার্যকে নিয়োগ দেন কিংবা অপসারণ করেন, সেহেতু আমরা বিষয়টি আচার্যকে অবহিত করব।
তিনি আরও বলেন, আমরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তাদের বক্তব্য, দাবি-দাওয়া ও পুরো ঘটনা তুলে ধরেছেন। ভালো আলোচনা হয়েছে, ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের কথা বুঝতে চেষ্টা করেছি। তাদের যে দাবিগুলো আছে শিক্ষার মান, আবাসনের মান কীভাবে উন্নত করা যায় সে সংক্রান্ত তারা নিজেরাই চিন্তা করে বেশ কিছু প্রস্তাব দাঁড় করিয়েছে। আমরাই বলেছিলাম, তাদের ঠিক করতে। আমরা যে প্রস্তাবগুলো দেখলাম, তার মধ্যে বেশ কিছু ইতোমধ্যে পূরণ করা হয়ে গেছে। আরও যেগুলো আছে প্রায় সবগুলোই আমরা আশা করি পূরণ করতে পারব। সে উদ্যোগ আমরা নেব।
এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ক্যাম্পাসে পৌঁছে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণ করে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কথা জানান তিনি।
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদসহ শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠকে উপাচার্যকে সব মহলের কাছে দুঃখ প্রকাশের আহ্বান তিনি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেন।
সে অনুযায়ী শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে দুঃখ প্রকাশ করে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বিবৃতিতে দেন। এতে তিনি গত ১৬ জানুয়ারির ঘটনায় আহত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানান।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জানুয়ারি বিকেলে তিন দফা দাবি আদায়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
এ ঘটনায় দুইশ থেকে তিনশ অজ্ঞাত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে- আন্দোলনরত দুইশ-তিনশ উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী হঠাৎ কর্তব্যরত পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তারা সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ধরে টানাটাানি করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া পুলিশের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ১৪ জানুয়ারি দিবাগত রাতে। তখন শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলে নানা সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান চেয়ে তারা হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক জাফরিন আহমেদকে কল করেন। প্রভোস্টকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘বের হয়ে গেলে যাও, কোথায় যাবে? আমার ঠেকা পড়েনি।’ শিক্ষার্থীরা বিষয়টি জরুরি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘কীসের জরুরি? কেউ তো আর মারা যায়নি।’
পরে প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রীরা। এরই মধ্যে ১৬ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি) ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তবে ওই নির্দেশনা অমান্য করে আন্দোলন চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়।
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ১৯ জানুয়ারি বিকেল ৩টা থেকে তার বাসভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এক পর্যায়ে আমরণ অনশনরত শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে ২৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙেন। তবে অনশন ভাঙলেও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।