সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ভেঙে ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্যপর্যায়ে অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে, যখন ইরানের সবচেয়ে মেধাবী পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়।

এ সময় মোহসেন ফাখরিজাদেহকে এমনভাবে হত্যা করা হয়, যেন এটি ছিল একটি স্পাই থ্রিলার চলচ্চিত্রের কাহিনী। কারণ, হত্যার পর আশেপাশে কোনও ক্লু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ, মোহসেন ফাখরিজাদেহকে বহনকারী গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মেশিনগানধারী রোবট।

সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি এড়িয়ে খুব সুনির্দিষ্টভাবে সম্পন্ন হয় এই গুপ্ত-হত্যাকাণ্ড। চলন্ত লক্ষ্যবস্তুকে এভাবে নিখুঁতভাবে হত্যা- মাঠ পর্যায়ে নিজস্ব কর্মীর দেওয়া তথ্য ছাড়া বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করেন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ভেদ করে ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে নিজের এজেন্ট ঢুকাতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলের মোসাদ।

ইসরায়েলকে ‘চরম শত্রু’ বলে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন ইরানের নেতারা। মধ্যপ্রাচ্যে হামাস ও হিজবুল্লাহ’র মতো ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তেহরান অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণসহ সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে- বিষয়টি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। তবে ইসরায়েলের আছে পারমাণবিক অস্ত্র। তেল আবিব এই অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার/ অস্বীকার কোনোটাই করে না। তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত- পুরোদমেই এ ক্ষমতার অধিকারী ইসরায়েল।

পরমাণু অস্ত্রধারী কোনও দেশে আগ্রাসন চালানো যায় না। অন্যদিকে, ইরানে হামলার বিষয়ে দীর্ঘকাল ধরেই আগ্রহ দেখিয়েছেন মার্কিন ও ইসরায়েলি জেনারেলরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুদ্ধের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

তাই ইরান দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে ব্যস্ত। এই প্রযুক্তি তারা অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করবে এমনই আশঙ্কা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের। তেল আবিব মনে করে, এমনটা হলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ণ হবে; তাই যেকোনও মূল্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ব্যাহত করতে চায়।

এজন্য ইরানের মাটিতেই কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ। এরই একটি নিদর্শন মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা।

ফাখরিজাদেহ নিহত হওয়ার পর ইরানের গোয়েন্দামন্ত্রী মাহমুদ আলাভি দাবি করেন, এই ঘটনার দুই মাস আগেই তিনি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ফাখরিজাদেহকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে সতর্ক করেন। এমনকি ঠিক যে জায়গায় এ বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়, ঠিক সেই স্থানকেই চিহ্নিত করেছিলেন সম্ভাব্য হামলার স্থান হিসেবে।

আলাভি আরও বলেন, “হত্যার পরিকল্পনাকারী ছিল সশস্ত্র বাহিনীর এক সদস্য। তবে আমরা সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে গোয়েন্দা অপারেশন চালাতে ব্যর্থ হয়েছি।”

একথার মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দেন যে, পরিকল্পনাকারী ছিল ইরানের অভিজাত ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সদস্য। তাই যদি হয়, তাহলে ওই গুপ্তচর বাহিনীটির এমন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- যিনি হামলার সতর্কবার্তাকে পদাধিকার বলে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন এবং পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে নির্ধারিত সময় ও স্থানে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছেন।

মোহসেন ফাখরিজাদেহ নিজেও আইআরজিসির একজন সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার হত্যা ইরানজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। হতচকিত হয় পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সন্দেহভাজন কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের রাখা হয়েছে ইরানের এভিন কারাগারে। সেখানকার সিকিউরিটি ওয়ার্ডের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, আইআরজিসির বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কমান্ডারকে সেখানে কয়েদি হিসেবে রাখা হয়েছে।

আইআরজিসির সুনামহানি যাতে না হয়- সেজন্যই এসব কর্মকর্তার নাম ও র‌্যাংক (পদ) জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি ইরান সরকার।

ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের বহির্বিভাগ ও গোপন শাখা কুদস বাহিনীর সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, বিদেশি গুপ্তচর সংস্থাগুলো ইরানের বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূত ও আইআরজিসি কমান্ডারদের ব্যাপারে একান্ত গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে।

কোনও নারীর সাথে তাদের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে কিনা- এমন তথ্যও তারা সংগ্রহ করে। এভাবে তাদের জিম্মি করে বিদেশি গুপ্তচরদের সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়।

এই কৌশলে বেশকিছু সফল অপারেশন পরিচালনা করেছে মোসাদ। যেমন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রাজধানী তেহরান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের একটি শিল্পাঞ্চলের গোপন সংরক্ষণাগারে প্রবেশ করে এক ডজন ব্যক্তি।

সেখানে ছিল ৩২টি মজুবত সিন্দুক ভর্তি অতি-গোপনীয় নথি। অনুপ্রবেশকারীরা সাত ঘণ্টারও কম সময়ে ২৭টি সিন্দুকের তালা গলিয়ে কমপক্ষে আধ টন ওজনের পারমাণবিক গবেষণার নথি নিয়ে যায়। পরে এসবের কোনও চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা ছিল ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনা, কিন্তু কর্মকর্তারা ব্যর্থতা ঢাকতেই হোক কিংবা ব্লাকমেইলের কারণে- মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।

তিন মাস পর চুরি হওয়া এসব নথি ১,২০০ মাইল দূরে তেল আবিবে দেখা যায়।

নথিগুলো প্রদর্শন করে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, এসব মোসাদ অভিযানেরই ফসল।

ওই সময়ে ইরানি কর্মকর্তারা নথিগুলোকে জাল বলে উল্লেখ করে দাবি করেন, এমন চুরির ঘটনা কখনওই ঘটেনি।

২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন হাসান রুহানি। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার দিন পরমাণু গবেষণার নথি চুরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি এ সংক্রান্ত প্রমাণ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও দেন।

তার আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে তেল আবিবে আয়োজিত এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে চুরি যাওয়া ইরানি নথি ভাণ্ডারের বিশেষ কিছু অংশ তুলে ধরেন নেতানিয়াহু। তিনি সেই সূত্রে ইরানের পরমাণু গবেষণায় মোহসেন ফাখরিজাদেহ’র ভূমিকার কথা জানান। নেতানিয়াহু দাবি করেন, ফাখরিজাদেহ পরমাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

নেতানিয়াহু এসময় বলেন, “ড. মোহসেন ফাখরিজাদেহ—এই নামটি মনে রাখবেন।” এর দুই বছর পরেই গুপ্তহত্যার শিকার হন বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী।

‘কথা না বলে, গুলি চালাও’

গত দুই দশকে ইরানের সেরা সেরা পরমাণু বিজ্ঞানীরা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া, অন্তর্ঘাতমূলক হামলার শিকার হয়েছে বেশকিছু পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটি। তারপরও হামলাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের রুখতে বা গ্রেফতারে ব্যর্থ হয়েছে ইরানি নিরাপত্তা বাহিনী।

২০১৩ সালে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনিজাদের ক্ষমতায় থাকার শেষ বছরে গুঞ্জন শোনা যায়- বেশ কয়েকজন আইআরজিসি কমান্ডার, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী আলেম ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তেহরান কখনও এসব গ্রেফতারের কথা প্রকাশ করেনি।

ওই সময়ে গ্রেফতারকৃতদের একজন ছিলেন- ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েল বিষয়ক কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান। প্রায় গোপনেই চলে তার বিচারকার্য, যেখানে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মোসাদ তার সরকারের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ে অনুপ্রবেশ করেছিলে- এ বিষয়টি গত বছর স্বীকার করেন আহমেদিনিজাদ।

গুপ্তচর ধরার কাজটি যে কতখানি কঠিন সেটিও উঠে আসে তার বক্তব্যে—“সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ যে কর্মকর্তা ইসরায়েলি গুপ্তচর প্রতিরোধে নিযুক্ত; যার কাঁধে ইসরায়েলি চক্রান্ত নস্যাতের গুরুভার—তাকেই যদি ইসরায়েলি চর বানিয়ে ফেলা হয়- সেটা কী খুব স্বাভাবিক ঘটনা!”

মোসাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কদাচিৎ মুখ খোলেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা আমোস গিলাদ বিবিসিকে জানান, সঙ্গতকারণেই এ গোপনীয়তা।

“আমি প্রচারবিরোধী নই; কিন্তু আপনি যদি গুলি চালাতে চান- তবে কথা বলা নিরর্থক। সুতরাং কথা নয়, গুলি চালানোই শ্রেয়। মোসাদের এই নীতি—সংস্থাটি কোনও প্রকার প্রচার বা ঘোষণা ছাড়াই সঙ্গোপনে অসাধারণ সব অভিযান চালিয়ে খ্যাতি/ কুখ্যাতি যাই বলুন অর্জন করেছে।”

এখন ইরানের সাবেক কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, মোসাদ ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট রুহানির শীর্ষ উপদেষ্টা ও ইরানের সাবেক গোয়েন্দামন্ত্রী আলি ইউনেসি এক সাক্ষাৎকারে এবিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, “দেশের কিছু জায়গায় মোসাদের প্রভাব এত ব্যাপক যে ইরানের সকল নেতার প্রাণভয়ে শঙ্কিত হওয়া উচিত।”

সূত্র: বিবিসি