ফ্যাশন সচেতন নারী মানেই তার সম্পত্তির তালিকায় একটি হলেও হাই হিল জুতা বা স্যান্ডাল আছেই আছে। তবে নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক এই হাই হিলের ব্যাপারে একটি তথ্য অনেকেই জানেন না আর তা হলো, হাই হিল পরার প্রথা সর্বপ্রথম চালু হয় পুরুষদের মাঝে! শুধু তাই নয়, অতীতে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পুরুষের স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হতো হাই হিল জুতা!

তবে অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও সত্যি যে প্রথম দিকে পুরুষদের পরার জন্যই হাই হিলের জুতা তৈরি করা হতো। বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার ঊর্ধ্বে প্রয়োজনীয়তাই ছিল হাই হিল ফ্যাশনের উদ্ভবের কারণ। এক সময়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েরই পায়ের পরিধেয়ের স্বতন্ত্র সংযোজন থাকলে সময়ের পরিক্রমায় হাই হিলের জুতার ব্যবহারের জায়গা ও উপাদান বদলেছে। তবে পুরুষের পা থেকে হাই হিলের জুতা কীভাবে নারীর পায়ে জায়গা করে নেয়? চলুন জেনে নেয়া যাক-

সর্বপ্রথম দশম শতকের প্রাচীন ইরান বা পারস্যের অশ্বারোহী সৈন্যদের হাই হিল জুতা পরতে দেখা যায়। ঘোড়ায় চড়ার সময় মাটি থেকে পা উঁচুতে রাখার জন্য তারা এ ধরনের বিশেষ জুতা ব্যবহার করতো। এছাড়া এটি তাদেরকে ছুটন্ত ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় তীর-ধনুক ও গুলি চালানোর সময় জুতার ভেতর তাদের পা কে ধরে রাখতো। ফলশ্রুতিতে তখনকার পারস্যের সাধারণ অশ্বারোহীরাও এক ইঞ্চি হাই হিল জুতা পরা শুরু করে।

ঘোড়ার দেখাশোনা বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় শিল্প যুগের আগের দিকে ঘোড়ার মালিক হওয়া যে কারোর জন্যই ঐশ্বর্যর পরিচায়ক হতো। এর ফলে হাই হিল পরিধানকারীর ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকতো। একাদশ শতকের শুরুর দিকে লাল রঙের হাই হিল জুতা পরার জন্য গ্রেট স্কিজমের পোপগণ স্বনামধন্য ছিলেন। পরে পারস্য সৈন্য ও অভিবাসীরা হাই হিল জুতার চর্চাকে ইউরোপে নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে হাই হিল ফ্যাশনের জন্ম দিয়েছিলো। ইউরোপীয় অভিজাত ব্যক্তিরা নিজেদের লম্বা দেখানোর জন্য একটি শক্তিশালী সামরিক কৌশল হিসেবে এই নতুন ধারাটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে।

ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই হাই হিলের রাজা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তার শাসনামলে মনে করা হতো, যে হিল যত উঁচু ও লাল হবে, পরিধানকারী তত বেশি শক্তিশালী হবে। তিনি ১৬৭০ সালে একটি আইন পাস করেন যে, শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরা হাই হিল জুতা পরতে পারবে। রাজা নিজে লাল রঙের হিল বা সোলের জুতা পরার পাশাপাশি তার দরবারের লোকদেরও লাল হিল পরার অনুমতি দিতেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়েই জুতার ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবউটিন নব্বইয়ের দশকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন।

সপ্তদশ শতকে ম্যাসাচুসেটসে একটি অদ্ভুত আইন প্রবর্তন হয়। আইন অনুযায়ী, যে নারীরা হাই হিল জুতা ব্যবহারের মাধ্যমে পুরুষদের প্রলুব্ধ করবে, তাদেরকে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ জুড়ে রেনেসাঁ এবং ইনলাইটেনমেন্ট বিপ্লব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের হিল পরার প্রবণতা কমে যেতে শুরু করে। শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থা প্রদর্শনের জন্য হাই হিল পরা এ সময় অযৌক্তিক হিসেবে গণ্য হয়েছিল। ১৭৪০ সালের মধ্যে পুরুষরা হাই হিল জুতা পরা বন্ধ করে দেয়।

নারীর পায়ে হাই হিলের সবচেয়ে পুরাতন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১২ শতকে ভারতের রামাপ্পা মন্দিরে একজন ভারতীয় নারীর ভাস্কর্যতে। ১৪০০-এর দশকে ইউরোপের নারীরা বিশেষ করে স্পেন ও ভেনিসে উচু প্ল্যাটফর্ম যুক্ত বিশেষ একধরনের জুতা পরতেন যাকে চপইন বলা হতো। এগুলো মূলত এক ধরনের খড়ম, যা পা কে রাস্তায় জমে থাকা নোংরা ও আবর্জনা থেকে বের করে আনার জন্য সাধারণ জুতার উপরে পরা হত। ফরাসী রানি ক্যাথরিন ডি মেডিসি ছলেন হাই হিল পরা প্রথম নারী। সময়টি ছিলো ১৫০০ দশকের মাঝামাঝি পর্যায়। এর আগ পর্যন্ত নারীরা শুধুমাত্র চপইন পরতেন। অষ্টাদশ শতকে প্রথমবারের মতো সাধারণ নারীরা হাই হিল ফ্যাশন চর্চা করতে শুরু করেন।

পুরুষের পা থেকে নারীদের পায়ে হাই হিলের জুতা যাওয়ার পেছনে মুলত ইনলাইটেনমেন্ট বিপ্লবই দায়ী। ১৮৫০-এর দশকে সেলাই মেশিনের উদ্ভাবন ও ব্যাপক উৎপাদনের ফলে হাই হিলগুলোরও ব্যাপকভাবে উৎপাদন ঘটে। এতে হাই হিল জুতার খরচ যথেষ্ট কমে আসার কারণে জনসাধারণের মাঝেও হাই হিল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে হাই হিলের জুতাগুলো পশ্চিমের অনেক মহিলার জন্য পেশাদারিত্বের প্রতীক হওয়া শুরু করে।

বিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রের বদৌলতে নারীদের হাই হিলের পশ্চিমা ফ্যাশন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নগ্ন পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে একত্রিত কাটআউট বা গোড়ালির স্ট্র্যাপসহ বাদামী ও সাদা পাম্প জুতাগুলো ছিল নারীদের হাই হিল ফ্যাশনের কেন্দ্রবিন্দু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পিন-আপ গার্ল-এর পোস্টারগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এই পোস্টারের মুল বিশেষত্বই ছিল একজন হাই হিল পরিহিত নারীর ছবি। এ সময় পুরো ইউরোগ-আমেরিকায় পিন-আপ গার্লের সংবেদনশীল ছবির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে যায়। এরই সূত্র ধরে ১৯৫০ সালে আগমন ঘটে লম্বা, চর্মসার স্টিলেটো হিল। এই নজরকাড়া হাই হিল জুতাটি ক্রমেই নারীত্বের প্রতীকে পরিণত হয়।

সে সময়ের বিখ্যাত তারকা মেরিলিন মনরো ও অড্রে হেপবার্নকে দেখা যেতে থাকে স্টিলেটো-হিল জুতা পরিহিত অবস্থায়। ফলশ্রুতিতে বিশ্ব জুড়ে নারীদের মাঝে হাই হিলের প্রতি আকর্ষণ বহুগুণে বেড়ে যায়। আশির দশকে অবদমিত অবস্থা থেকে হাই-হিল ফ্যাশনকে টেনে তুলেছিলো মানোলো ব্লাহনিকের মতো ডিজাইনাররা। হাই হিলের রীতিমত পুনরুত্থান হয় যখন এদের পাশাপাশি ম্যাডোনার মতো বিখ্যাত তারকারা প্রসাধনীর পরিবর্তে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসাবে হাই হিলযুক্ত জুতা এবং বুট পরা শুরু করে।

যুদ্ধ, আইন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক বিপ্লব পেরিয়ে এভাবেই হাই হিল জুতা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। কালক্রমে ফ্যাশন প্রবণতা পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাই হিল পৌরুষ দীপ্ত ও জৌলুস প্রতাপ থেকে নিজের অবস্থান খুঁজে নিয়েছে নারীর সৌন্দর্যের অববাহিকায়। এখন নারীর দেরাজের অবধারিত সংযোজন হিসেবে শোভা পায় হাই হিল জুতা।

বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের হিল পরার অভ্যাস চালু আছে নারীদের মাঝে। সমকামি পুরুষেদেরও মাঝে মাঝে হিল পরতে দেখা যায়। এখন আর সামাজিক মর্যাদা হিসেবে পুরুষেরা হাই হিল পরে থাকেন না। তবে কেউ যদি হাই হিলকে মেয়েদের বৈশিষ্ট্য বলে জাহির করবার চেষ্টা করে তবে তাকে মনে করিয়ে দেবেন, এক সময় পুরুষের থেকেই এসেছে এর প্রচলন!