রাজশাহীতে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের পর থেকে করোনায় আক্রান্ত কিংবা লক্ষণ নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের প্রায় ৪০ শতাংশের ফুসফুসে গুরুতর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। করোনার এই ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত রোগীকে দুর্বল করে ফেলছে। একই সঙ্গে সংক্রমণের ফলে ফুসফুসের ৬০-৬৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।

এসব রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা বা ঘনত্ব ঠিক রাখতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, ভেন্টিলেটর ও বাইপ্যাপের প্রয়োজন হয়। তবে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ২০টি। অপেক্ষায় থাকছেন ৭০-৮০ জন রোগী। প্রাথমিকভাবে এসব রোগীকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা কিংবা বাইপ্যাপের মাধ্যমে উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন দেওয়া হয়।

রামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালে প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ করোনা রোগী গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হচ্ছেন। যাদের ফুসফুসে গুরুতর সংক্রমণ রয়েছে। এ কারণে রোগীর গুরুতর শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। এসব রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা বা ঘনত্ব প্রায় ৬৫ শতাংশের নিচে। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা আইসিইউতে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা। যেখানে প্রতি মিনিটে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

অথবা তাদের প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, যা প্রতি মিনিটে ৭৫ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে। অথচ হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীকে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। তবে এটি প্রতি মিনিটে ২০-২৫ শতাংশের বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। ফলে অক্সিজেনের মাত্রা কম নিয়ে রামেকের করোনা ইউনিটে আসা বেশিরভাগ রোগীকে মৃত্যুঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে।

রামেক হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে যারা করোনায় আক্রান্ত কিংবা লক্ষণ নিয়ে আসছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে নিতে আসছেন। কেউ কেউ তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন। তাদের প্রাথমিকভাবে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি থেকে নামানো কিংবা বিশেষ প্রয়োজনে রোগীর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুললেই ছটফট করছেন। অনেক দুর্বল রোগী অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন। এমন দৃশ্য দেখে পাশে থাকা স্বজনরা দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিচ্ছেন।

হাসপাতালের ৩ নম্বর কোভিড ওয়ার্ডে করোনার লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী এলাকার মালতি বেগম। তার বয়স ৫৫ বছর। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিল। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় অক্সিজেন মাস্ক নাকের নিচে নেমে যায়। মুহূর্তেই তিনি অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি প্রকাশ শুরু করেন। এ অবস্থায় দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেন স্বজনরা।

একই ওয়ার্ডের বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন শাম্মী আক্তার। তিনি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার বাসিন্দা। ৫০ বছর বয়সী এই নারী গত ছয় দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রথমে তাকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। পরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন দেওয়া হয়। রবিবার ফুসফুসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তাকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মাধ্যমে উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন দেওয়া হয়।

তার স্বজন জব্বার মিয়া জানান, চিকিৎসক বলেছেন রোগীর ফুসফুস প্রায় ৬০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তাকে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। তবে তার শারীরিক অবস্থা খুবই দুর্বল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে রবিবার করোনা ওয়ার্ডে ৪৪৫ শয্যার বিপরীতে ৫০৬ রোগী ভর্তি ছিলেন। এদের প্রায় ৪০ শতাংশের উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে। হাসপাতালে উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন সরবরাহে গত সপ্তাহে ৬৯টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সরবরাহ ছিল। এখন তা বাড়িয়ে ৮৭টি করা হয়েছে। যেগুলো ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অপর্যাপ্ত।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনায় আক্রান্ত ও লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বড় একটি অংশের ফুসফুসে গুরুতর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের পর থেকে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। যাদের ফুসফুসের ৮০ শতাংশে গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয় তাদের বাঁচানো যায় না।

তিনি বলেন, রাজশাহী মেডিক্যালে বর্তমানে করোনা ইউনিটে ১২৫ জন চিকিৎসক ও ৫২৫ জন নার্স তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করছেন। করোনা ইউনিটের প্রত্যেক ওয়ার্ডে সবসময় একজন করে চিকিৎসক থাকছেন। চিকিৎসক কয়েকবার করে রোগীদের কাছে যাচ্ছেন। তারা আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। ফুসফুসের সংক্রমণ বাড়তে থাকা রোগীদের উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন সরবরাহে ৮৭টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ও ১৬টি বাইপ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে।