প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সামুদ্রিক সম্পদ ও সামুদ্রিক বাণিজ্য রক্ষায় সমুদ্রে নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।বুধবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে ‘ফ্রেন্ডশিপ বিয়ন্ড দ্য হরাইজন’ শীর্ষক বাংলাদেশ নৌবাহিনী আয়োজিত কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফ্লিট রিভিউ-২০২২-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ আইএফআরের আয়োজন করেছে।

তিনি বলেছেন, আমাদের সরকার সামুদ্রিক সম্পদের অপার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে সামুদ্রিক খাতের উন্নয়নে ব্যাপক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু সমৃদ্ধ অর্থনীতি কেবল তখনই সম্ভব, যখন আমরা সমুদ্রে একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবো।

সে লক্ষ্যে তার সরকার সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় পরিকল্পিত সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, ভারত, চীন, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস ও স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ২৮টি দেশের নৌবাহিনী ও মেরিটাইম সংস্থার অংশগ্রহণে চারদিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক ফ্লিট রিভিউ (আইএফআর) শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ সমুদ্র অপরিহার্য। কারণ, বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক সীমানার মাধ্যমে আমাদের সব দেশ বিভক্ত হলেও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমরা একই সূত্রে গাঁথা। ‘ফ্রেন্ডশিপ বিয়ন্ড দ্য হরাইজন’- এ উপজীব্যকে ধারণ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আয়োজিত ‘আইএফআর-২০২২’ ইভেন্টটি আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে। যা সব সামুদ্রিক দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধিৎ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

সরকারপ্রধান বলেন, অবাধ বৈশ্বিক বাণিজ্যের স্বার্থেই সমুদ্রকে নিরাপদ রাখা আবশ্যক। সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও অনুসন্ধানের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সে লক্ষ্যে এই কক্সবাজারেই তার সরকার একটি সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনায় আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। জাতি হিসেবে আমরা সর্বদা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। সেই নীতি মেনেই আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিশেষত, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে আমরা এ নীতিমালাই মেনে চলি।

তিনি বলেন, নিকট প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক সব দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
আমরা বিশ্বাস করি সংঘাত নয়, সমঝোতা এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করা হচ্ছে যুদ্ধ করার জন্য নয়। আমাদের লক্ষ্য শান্তি এবং সৌহার্দ্য স্থাপন করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো যুদ্ধ যে মানবজাতির জন্য কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমরা তা নিজেরা দেখেছি। বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানবজাতির জন্য ভয়াবহতা ডেকে আনছে। কাজেই আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।

সরকারপ্রধান বলেন, আমি আন্তর্জাতিক মহলের সবার কাছে এই আহ্বানই জানিয়েছি, যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। কোনো সমস্যা থাকলে শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে হবে।

নিকট অতীতে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতিফলন দেখাতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত মতপার্থক্য সৌহার্দপূর্ণভাবে সমাধান এবং ভারতের সঙ্গে স্থল সীমানার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা যে সমুদ্রসীমা আইন করে যান তার ভিত্তিতেই প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। আর এই আইনটি জাতিসংঘ অনেক পরে ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করেছিল। জাতির পিতা ভারতের সঙ্গেও স্থলসীমানা চুক্তি করে। সে অনুযায়ী আমাদের সংবিধান সংশোধন করে যান এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ নিলে ভারতের সংসদে দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল সর্বসম্মতভাবে আইনটি পাস করে।

তিনি আরও বলেন, এতো সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় একটি বিরল ঘটনা। কাজেই বন্ধুত্বপূর্ণভাবে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায়, এটাই আমরা বিশ্বাস করি। শান্তি আমাদের সমৃদ্ধি এনে দেয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোনালি বালুকাময় সৈকত। বাংলাদেশ বিপুল সম্ভাবনার দেশ। আমি আশা করি, আইএফআর ২০২২-তে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সমুদ্র, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা, পর্যটন ইত্যাদি সর্ম্পকে সম্যক ধারণা পাবেন।

তিনি বলেন, আমি অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, যাদের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা আজকের আইএফআর সম্মেলনকে এতো বর্ণিল ও মনোমুগ্ধকর করেছে। আমি বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য।
বিদেশি অতিথি যারা অংশ নিয়েছেন, আপনাদের বাংলাদেশে অবস্থান আনন্দদায়ক এবং সুখময় হোক- এই কামনা করছি।

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বিদেশি জাহাজের ক্রুদের বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ, সিল কমান্ডোদের মহাকাশ থেকে ফ্রি-ফল জাম্প, নানা কসরৎ এবং বহরের অপারেশনাল প্রদর্শনী উপভোগ করেন।

তিনি ‘বঙ্গবন্ধু ও নৌবাহিনীর ৫০ বছরে যাত্রা’ শিরোনামের একটি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করেন। এছাড়াও সমুদ্র সৈকতে নৌবাহিনীর একটি জেটি উদ্বোধন করেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম শাহীন ইকবাল।

অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রার ওপর আলোকপাত করে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয়।