দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের কারণে সম্প্রতি দেশে আমেরিকান ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি আজ এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একটি হুন্ডি চক্র শনাক্তের পর সিআইডি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের ভয়াবহ এক চিত্র জানায়। মেবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের এই চক্রের ১৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- আক্তার হোসেন, দিদারুল আলম সুমন, খোরশেদ আলম ইমন, রুমন কান্তি দাস জয়, রাশেদ মাঞ্জুর ফিরোজ, মো. হোসাইনুল কবির, নবীন উল্লাহ, মো. জুনাইদুল হক, আদিবুর রহমান, আসিফ নেওয়াজ, ফরহাদ হোসাইন, আবদুল বাছির, মাহাবুবুর রহমান সেলিম, আবদুল আউয়াল সোহাগ ও ফজলে রাব্বি। তাদের মধ্যে ৬ জন বিকাশ এজেন্ট, ৩ জন বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার, ৩ জন বিকাশের ডিএসএস, ২ জন হুন্ডি এজেন্ট, একজন হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী ও একজন হুন্ডি পরিচালনাকারী বলে জানিয়েছে সিআইডি।
দেশে আমেরিকান ডলারের দাম সম্প্রতি অস্বাভাবিক বাড়ায় বাজার চরম অস্থির হয়, বাড়ে সব পণ্যের দাম। নাগরিকদের জীবন পালনের ব্যয় হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ডলারের দাম লাফিয়ে বাড়ার কারণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, প্রশ্ন ও কৌতুহল তৈরি হয় জনমনে। বৃহস্পতিবার সিআইডির সংবাদ সম্মেলনে তার উত্তর মেলে।
বুধবার দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, চার সিমে তিন কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ ইলেক্ট্রনিক মানি এবং ৩৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
সিআইডি বলছে, দেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) সারাদেশে অবৈধ পাঁচ হাজার এজেন্ট রয়েছে। গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। দেশে ডলারের দাম বাড়াসহ নানা কারণে তদন্ত শুরু করে এমন তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গত ৪ মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের ৫ হাজার এজেন্ট এমএফএস মাধ্যমে হুন্ডির সঙ্গে জড়িত। এই পাঁচ হাজার এমএফএস এজেন্টের মাধ্যমে চার মাসে হুন্ডি হয়েছে আনুমানিক পঁচিশ হাজার কোটি টাকা।
সিআইডি প্রধান বলেন, রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতির এ ঝুঁকি মোকাবিলায় হুন্ডি কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি শুরু করে সিআইডি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার এবং দেশের বাইরে অবস্থানরতদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপে আছে অর্থ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। তারা দেশীয় মুদ্রায় উক্ত অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর নিকট হতে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে।
এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। এ বিষয়ে মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ডলারের দাম বৃদ্ধির পরপরই কেন অভিযান চালিয়ে চক্রটিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা গেল না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার কারণে ধরা যায়নি। সিআইডির গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা তথ্য মিল পাওয়ার ভিত্তিতে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমার বিশ্বাস এর একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।
সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্ট অবৈধ কার্যক্রম করছে। আমরা তিনটি গ্রুপকে ধরেছি। ইতোমধ্যে যারা অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল সিআইডির তৎপরতায় সেখান থেকে তারা সরে আসতে শুরু করেছে। আমরা ইন্টেলিজেন্স বেইজ অপারেশন পরিচালনা করি। সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। দু-একদিনের মধ্যে অবৈধভাবে লেনদেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে।
হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকা জঙ্গিবাদের কোনো কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, তদন্ত করে দেখা হবে বিষয়টি।
টাকা পাচারের বিষয়ে গ্রেপ্তার চক্রটির কার্যক্রম তুলে ধরে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, হুণ্ডিচক্রের সদস্যরা প্রবাসে বাংলাদেশির কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করেন দেশে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা বিদেশি মুদ্রা না পাঠিয়ে সমমূল্যের বাংলাদেশি টাকা দেশে পরিবারকে বুঝিয়ে দেন। তাতে দেশ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা থেকে বঞ্চিত থাকে।
সিআইডি জানায়, হুন্ডিচক্রটি তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় গ্রুপ কাজ করে দেশে। হুন্ডির সমপরিমাণ অর্থ তারা বাংলাদেশি টাকায় নির্দিষ্ট মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টদের দেয়। ওই এমএফএস এজেন্টরা হল তৃতীয় গ্রুপ। হুন্ডি হয়ে তাদের হাতে আসা টাকা তারা দেশে নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে পরিশোধ করে। আবার দেশ থেকে ঠিক এর উল্টো প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয়। এসব চক্র অবৈধভাবে এমএফএস এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। যা আইনের চোখে অপরাধ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে সিআইডি।