দীর্ঘ ২৪ বছর আগে হত্যার শিকার হন তৎকালীন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। ওই হত্যার ঘটনায় করা মামলার ৮নং আসামি ছিলেন ট্রাম্পস ক্লাবের স্বত্বাধিকারী আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী। চিত্রনায়ক সোহেল হত্যার ২৪ বছর পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানায় তিনি প্রথম আসামি। পরোয়ানা জারির এক মাস পর গত ২৮ মার্চ সেটি হাতে পায় র‌্যাব।

এরপর গোয়েন্দা তথ্য অনুসন্ধানের পর মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি ভাড়া বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়।

র‌্যাব জানিয়েছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জেরে উচিত শিক্ষা দিতেই চিত্রনায়ক সোহেলকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন আশিষ রায়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর কানাডায় পালাতে চেয়েছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে নতুন মামলা হবে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব।

বুধবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। যার মামলা নম্বর ৫৯। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ৯ জনের বিরুদ্ধে ডিবি পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ২০০১ সালে ৩০ নভেম্বর মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে মামলা বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই মামলার ১নং আসামি আদনান সিদ্দিকী দুই বছর পর হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেন। পরে হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট পুনরায় আরেকটি রায় দেন। এ রায়ে আগের জারি করা রুলটি খারিজ করে দেওয়া হয়। প্রত্যাহার করা হয় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ।

সর্বশেষ চলতি বছরের গত ২৮ মার্চ আদালত অনুপস্থিতির কারণে ছয় পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন। এরও এক মাস পর পরোয়ানার কপি সংগ্রহ করে র‌্যাব।

গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে গত রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর গুলশান থেকে চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে (৬৩) গ্রেপ্তার করা হয়— জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

ট্রাম্পস ক্লাব ছিল অসামাজিক কার্যক্রমের আখড়া

১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদীন টাওয়ারে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ট্রাম্পস ক্লাব। সেটির যৌথ স্বত্বাধিকারী ছিলেন আশিষ রায় চৌধুরী ও আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম। ক্লাবটিতে বিভিন্ন বয়সীরা ভোর পর্যন্ত নানা অসামাজিক কার্যকলাপে অংশ নিতেন।

আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাং-সন্ত্রাসীর মিটিং হতো ট্রাম্পস ক্লাবে

আশিষ রায় ১৯৯৬ সাল থেকেই ক্লাবে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন। পরে ট্রাম্পস ক্লাবটিতে সব আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন এবং গ্যাং লিডারদের আনাগোনা বাড়ে ও আখড়ায় পরিণত হয়। সেখানে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের চক্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিটিংয়ের জন্য সেই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সুবাদে ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাতিজিকে বান্টি ইসলাম বিয়ে করার সুবাদে তাদের মধ্যে একটি আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল।

উচিত শিক্ষা দিতেই চিত্রনায়ক সোহেলকে হত্যা

বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে চলত অনৈতিক কার্যক্রম ও উচ্চশব্দে গান-বাজনা। এর প্রতিবাদ করেছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। এ নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গেও বাগবিতণ্ডা হয়। প্রকাশ্যে অপমান করায় সোহেল চৌধুরীকে উচিত শিক্ষা দিতে ওই ক্লাবের স্বত্বাধিকারী আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী ও আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলামের যৌথ পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে। হত্যার দায়িত্ব নেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তিনি তখনকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে দায়িত্ব দেন। ইমনসহ তার গ্যাং ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই বনানী ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে গুলি করে হত্যা করে নায়ক সোহেল চৌধুরীকে।

গ্রেপ্তার আশিষ রায় জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে বলেন, তিনি ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটি এয়ারলাইন্সের ডিরেক্টর (অপারেশন্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি আরেকটি এয়ারলাইন্সের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত তিনি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।

পলাতক আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আশিষ রায়ের

আশিষ রায় অসংখ্যবার বিদেশে গেছেন। তিনি কানাডায় চার/পাঁচ বছর ছিলেন। বর্তমানে কানাডায় পলাতক বান্টি ইসলাম, থাইল্যান্ডে পলাতক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া আদনানের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া ওই মামলার অপর আসামি ফারুক, লিটন, ইমন ও তারেক সাঈদ জেলে রয়েছে।

গ্রেপ্তার এড়াতে কানাডায় পালাতে চেয়েছিল আশিষ রায়

গত ২৮ মার্চ আশিষ রায় চৌধুরীর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন তিনি। এজন্য ৭ এপ্রিল কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। এ কারণে নিজের বাসা ছেড়ে গুলশানে একটি বাসা ভাড়ায় উঠেন। যেটি একটি পাঁচ তারকা হোটেলের এমডি ভাড়া করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে কানাডায় যেতে তিনি একটি এয়ারলাইন্সের টিকিটও কাটেন।

আশিষ রায়ের বিরুদ্ধে হবে মাদক আইনে নতুন মামলা

আশিষ রায়ের বিরুদ্ধে নতুন কোনো মামলা হবে কি না ও পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ কী— জানতে চাইলে র‌্যাব মুখপাত্র কমান্ডার মঈন বলেন, তার মাসে সাত লিটার মদ পান করার লাইসেন্স রয়েছে বলে দাবি করেছেন। যদিও তিনি সেটি দেখাতে পারেননি। আমরা অভিযানের সময় তার ভাড়া বাসা থেকে ২২ বোতল বিদেশি মদ, ১৪ বোতল সোডা ওয়াটার, একটি আইপ্যাড, ১৬টি বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, দুটি আইফোন ও নগদ দুই লাখ টাকা জব্দ করেছি। এজন্য নতুন করে তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে একটি মামলা করা হবে। পাশাপাশি সোহেল হত্যা মামলায় তাকে থানায় সোপর্দ করা হবে।

আদালত পরোয়ানা জারি করার এক মাস পর সেটি র‌্যাব হাতে পায়। থানায় পরোয়ানার কপি গেলেও সেটি অজ্ঞাত কারণে নিখোঁজ হয় বলে অভিযোগে উঠে। এসবের মধ্যে আশিষ রায়ের কোনো হাত ছিল কি না— জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, আমরা পরোয়ানার কপি স্বউদ্যোগে সংগ্রহ করেছি। পরোয়ানার তথ্য পেয়ে তিনি নিকটজনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে বলেন। তবে তিনি কানাডায় পালাতে চেয়েছিলেন। পরোয়ানার কপি থানা থেকে নিখোঁজ হওয়া বা দাপ্তরিক কোনো জটিলতা হয়ে থাকলে সেটা সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখবেন।