কয়েক সেকেন্ডের এক ঝাকুনিতে ঝরে গেছে ১০টি তাজা প্রাণ। গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দিয়েছে ঢাকাসহ সারাদেশের অসংখ্য ভবনে, হেলে পড়েছে কয়েকটি। তারই মাঝে শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে তিনটি আফটার শক।
সবমিলিয়ে ভূমিকম্পের আতঙ্ক কাটেনি গত তিন দিনেও। কারণ ছোট-বড় এমন আফটার শক আরও হতে পারে। ফলে শুক্রবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর অসংখ্য মানুষ আজও রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনে যাদের বসবাস, তারা রয়েছেন মহাআতঙ্কে।
রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষকে সেই আতঙ্ক থেকে একটু স্বস্তি দিতে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে সতর্কতামূলক নানা ব্যবস্থা। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে আবাসিক শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় অনলাইন ক্লাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সকাল আটটা পর্যন্ত গ্যাস কূপ খনন ও ভূতাত্বিক জরিপ কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রোববার (২৩ নভেম্বর) সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া যায়, এমন অ্যাপ তৈরি করা যায় কি না, সেটি বিবেচনা করছে সরকার।
গ্যাস কূপ খনন বন্ধ
সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোর গ্যাসকূপে আগামী মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) পর্যন্ত খনন কাজ ও সাইসমিক সার্ভে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রোববার (২৩ নভেম্বর) জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সূত্র মতে, এই মুহূর্তে খনন কাজ চলমান রয়েছে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসকূপে। ভূমিকম্পের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবেই সে খনন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রোববারের বৈঠকে তা আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
যেসব গ্যাসকূপের খনন কাজ বন্ধের কথা জানা গেছে সেগুলো হলো- কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় অবস্থিত শ্রীকাইল গ্যাসফিল্ড, হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ড এবং সিলেট গ্যাসফিল্ডের আওতাধীন কৈলাশটিলা গ্যাসকূপ।

গত শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন আতঙ্কে তিন ও চারতলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
এ ঘটনার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস ও পরীক্ষা আগামী ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে আবার ৭ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত শীতকালীন ছুটি রয়েছে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের মতামতের প্রেক্ষিতে ভূমিকম্প পরবর্তী আবাসিক হলগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সামগ্রিক ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার বলে জানিয়েছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এই ঝুঁকি নিরূপণ ও সম্ভাব্য সংস্কারের স্বার্থেই আবাসিক হলগুলো খালি করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে কর্তৃপক্ষ।
একইসঙ্গে রোববার (২৩ নভেম্বর) বিকেল পাঁচটার মধ্যে সকল আবাসিক হল খালি করার নির্দেশ দেয় ঢাবি প্রশাসন। ভূমিকম্প ও আফটার শকের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত বিবেচনা এবং সার্বিক নিরাপত্তা স্বার্থে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ঢাবি।
শতবর্ষের প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হল পুরনো এবং জরাজীর্ণ। এর মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ভেঙে পড়তে পারে- এমন আতঙ্কে হল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে তিনবার ভূমিকম্পের পর এই হলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও কখনো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়নি।

এমন অবস্থায় পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বৈঠকে ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি নিরীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে ওই হলের প্রত্যেকটি কক্ষসহ বিভিন্ন হলের পুরাতন ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অবিলম্বে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ দল রোববার (২৩ নভেম্বর) সকাল থেকেই মুহসীন হল এবং বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল পরিদর্শন করেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য হলও পরিদর্শন করা হবে বলে জানান তিনি।
রফিকুল ইসলাম জানান, আবাসিক হলের প্রতিটি রুমের চাবি হল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে বিশেষজ্ঞ দল প্রতিটি কক্ষ পরিদর্শন করতে পারেন। কারিগরি মূল্যায়নের পর ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হলে শিক্ষার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় হল নির্মাণের কাজ আগামী মার্চ মাসে শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। নতুন হল নির্মাণের ক্ষেত্রে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
একইসঙ্গে ঢাবির চিকিৎসা অনুষদের অধীনে চলমান এমবিবিএস পরীক্ষাগুলো আগামী ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজসহ পঞ্চাশের বেশি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধিভুক্ত।

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস
এদিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ভবনে ভূমিকম্পের ফলে ফাটল দেখা গেছে- এরকম বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের পরিচালক সৈয়দ মানসুর হাশিমের পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে তেমন কোনো ত্রুটির প্রমাণ মেলেনি।
এতে বলা হয়েছে, ‘পুরো ক্যাম্পাস অনেকগুলো এক্সপ্যানশন জয়েন্ট ব্যবহার করে নির্মাণ করায় এই ভবনগুলো উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক নড়াচড়ায় ভবনের চাপ সহনীয় করতে নির্মাণের কৌশল হিসেবে- এক্সপ্যানশন জয়েন্ট ব্যবহৃত হয়।’
শুক্রবার ভূমিকম্প হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভবন নিয়ে কোনো ধরনের ভুল ও অপতথ্য না ছড়ানো এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সহযোগিতা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা
দুই দিনে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের ঘটনায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে একদিনের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত হলেও পরে চার দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। রোববার ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত ছিল। পরে বিকেলে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছুটির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পরে ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ নভেম্বর সকাল ১০টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র আবাসিক হল নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল ত্যাগের নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হবে।

আইডিয়ালসহ কয়েকটি স্কুলে ক্লাস, পরীক্ষা স্থগিত
ভূমিকম্প আতঙ্কে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলে ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিতের খবর পাওয়া গেছে। আবার কোনো কোনো স্কুলে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে রাজধানীর অনেক সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজে যথারীতি ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও জানা গেছে।
অনিবার্য কারণবশত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের রোববারের প্রথম থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা এবং একাদশ শ্রেণির কুইজ পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগমের স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে কলেজ শাখার একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম চালু রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে, ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে কী করতে হবে, সে বিষয়ে আট দফা নির্দেশনা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ভূকম্পন অনুভূত হলে শান্ত ও স্থির থাকা এবং ভবনের নিচ তলায় থাকলে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নেওয়া, বহুতল ভবনে থাকলে ড্রপ, কাভার, হোল্ড পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
এই প্রক্রিয়ায় ভূমিকম্প অনুভূত হলে প্রথমে নিচু হয়ে, শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে খুঁটি শক্ত করে ধরা অথবা কলামের পাশে, বিমের নিচে আশ্রয় নেয়ার পরামর্ম দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সম্ভব হলে বালিশ, কুশন বা এ জাতীয় বস্তু দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
ভূমিকম্প চলাকালীন লিফট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা এবং ভূমিকম্প থামার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক ও গ্যাস সংযোগ দ্রুত বন্ধ করার পরামর্শও দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।












