মুক্তিযুদ্ধ, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় জীবনব্যাপী অবদানের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর গুণীজন সম্মাননা ২০২৩ প্রদান করা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে টাইমস মিডিয়া ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানটি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। তাঁরা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কীর্তি ও অবদানের কথা বলেন।
ডা. জাফরুল্লাহ গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। বিলেতের সুখ-সুবিধা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে দেশে ফিরে আসেন। এফআরসিএস পড়া বাদ দিয়ে যুদ্ধাহতদের জন্য খোলেন ফিল্ড হাসপাতাল। যুদ্ধ শেষে দেশ গড়তে নিজেকেই নিয়োজিত করেন। তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
৮২ বছর বয়সী জাফরুল্লাহ চৌধুরী অশক্ত শরীরে সম্মাননা অনুষ্ঠানের মঞ্চে হুইলচেয়ারে বসে, তাঁর গুণমুগ্ধদের কথা শুনেছেন। কখনও মৃদু হেসেছেন। কখনও মাথা নেড়ে দ্বিমত করেছেন। অভ্যাগত সবাই বললেন, সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন ‘জাফর ভাই’। সম্মাননার জমকালো অনুষ্ঠানেও সাদামাটাই ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আসেন লুঙ্গি পরে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজন ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। তাঁকে ডাকতেন ‘ডাক্তর’ বলে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পর দেশ গড়ার সংগ্রামে স্মৃতিকাতর হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ড করতে চেয়েছিলেন। মুজিব ভাইয়ের এ স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। মুজিব ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হলে এত মানুষ আত্মহত্যা করত না। কিশোররা খুনখারাবিতে জড়াত না। সবাই খেতে পারত। চাকরি না থাকলে ভাতা পেত।’
সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের অনুপ্রেরণায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতে সম্মাননার চেক তুলে দেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তরুণ চক্রবর্তী।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানান এ. কে. আজাদ। সম্মাননা পদক তুলে দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মান জানাতে পেরে সবাই সম্মানিত হয়েছি। ডা. জাফরুল্লাহ চাইলে এ দেশের শীর্ষ ধনী হতে পারতেন। তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। কিন্তু নিজে মালিক হননি। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা সামাজিক, ব্যক্তিগত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে সমাজ বদলের বিপ্লব। সেই বিপ্লবের সৈনিক ডা. জাফরুল্লাহ। সম্পদ থাকলে দাতা হওয়া যায়। কিন্তু সমাজ বদলে নিজেকেই দান করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যা আর কেউ পারে না।
সবাই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল সরাসরি করেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের হয়ে, এককভাবে কাজ করে জনকল্যাণের রাজনীতির পথ দেখান কিছু বিরলপ্রজ মানুষ। ডা. জাফরুল্লাহকে তেমনই এক ব্যক্তি মনে করেন সমকাল সম্পাদক। মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, এ কারণে তাঁর অন্যায় সমালোচনা উচিত নয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য তাঁর সারাজীবনের যে ত্যাগ, তা অতুলনীয়। সম্মাননার প্রকাশনা ও চিত্রকর্ম জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতে তুলে দেন সমকাল সম্পাদক।
তরুণ চক্রবর্তী বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহকে সম্মান জানাতে পেরে সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর সম্মানিত হয়েছে। যাঁরা দেশের জন্য অনুকরণীয় ত্যাগ স্বীকার ও আত্মোৎসর্গ করেছেন, তাঁদের সম্মান জানাবে সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এর পর মুক্ত আলোচনায় প্রিয় ‘জাফর ভাই’কে নিয়ে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের যে কোনো বিপদে ছুটে যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর মতো একজনও নেই।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন, জীবিত মানুষকে সম্মান দিতে পারি না। মৃত্যুর পর অনেক কথা হয়। আজ অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হলাম।
মুক্ত আলোচনায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্ম সম্পর্কে আরও বলেন, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত জুলিয়ান ফ্রান্সিস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, অধ্যাপক আবদুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সাবেক সচিব এনাম আহমদ চৌধুরী, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রামরুর চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিক, নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির, ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, ডা. জাফরুল্লাহর ছোট বোন কবি আলেয়া চৌধুরী প্রমুখ।