দিনাজপুরে চাকরির সুবাদে জাকির হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদের (৭২) পরিচয় হয়। তিনি অবসরে যাওয়ার পরও তাদের যোগাযোগ ছিল। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শহীদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ধার নেন জাকির। সেই টাকার নিয়েই তাদের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। লেনদেনের বিষয়টি তারা দুজন ছাড়া আর কেউ জানত না। এ সুযোগ নিয়ে ৫/৬ মাস আগে আনোয়ার শহীদকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর শ্যামলীতে জনবহুল সড়কে প্রকাশ্যে শহীদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় হত্যাকারী মো. সাইফুল ইসলাম ও মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার পর শ্যামলীতে আনোয়ার শহীদকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের ছোট বোন ফেরদৌস সুলতানা (৫৯) আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। র‌্যাব এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব সদর দফতর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে রোববার রাতে রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেন (৩৭) ও এবং হত্যাকারী মো. সাইফুলকে (২৬) গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে।

র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, আনোয়ার শহীদ গম গবেষণা কেন্দ্রে ১৯৭৬ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৮ সালে পরিচালক পদ মর্যাদায় প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মস্থল জয়দেবপুর থেকে অবসর নেন। তিনি ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে মো. জাকির হোসেনের পরিচয় হয়।

গত ১১ নভেম্বর নিহত আনোয়ার শহীদ পূর্ব পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা করতে শ্যামলীতে একটি বাস কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় শ্যামলীর হলি লেন গলিতে এলে তিনি দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৭টা ১৫ পর্যন্ত ওই গলির মুখে মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ পরে একজন লোক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। ভিকটিম আনোয়ার শহীদ প্রধান সড়ক থেকে গলিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুর্বৃত্ত তার দিকে এগিয়ে যায় এবং পকেট থেকে ছুরি বের করে ভিকটিমের পেটে আঘাত করে সরে যায়। ভিকটিমকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে ছুরিকাঘাতের বিষয়টি পথচারীরা বুঝতে পারলে হত্যাকারীকে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার জাকির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিহত আনোয়ার শহীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে জাকির ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে নেয়। ভিকটিম অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো।

এক বছর আগে জাকির তার চালের গোডাউন বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা লোন পাইয়ে দিতে ভিকটিমের সহযোগিতা চায়। ভিকটিম তাকে সহযোগিতা করতে অপারগতা জানায়।

নিহত শহীদ বছরখানেক আগে পাওনা ১২ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রেফতার জাকিরকে চাপ দেন। টাকা লেনদেন সম্পর্কে নিহত আনোয়ার শহীদ ও জাকির ছাড়া কেউ জানত না। টাকা যাতে ফেরত দিতে না হয় সেজন্য জাকির গত ৬/৭ মাস ধরে শহীদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। জাকির হত্যাকাণ্ডের ৩/৪ মাস আগেও একবার শহীদকে তার পরিচিত ধান/চালের চাতাল শ্রমিক মো. সাইফুলকে দিয়ে পরিকল্পনা করে ঢাকায় হত্যার চেষ্টা করেন।

গ্রেফতার সাইফুল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে এক সময় জাকিরের চালের গোডাউন কাজ করত। ৩/৪ মাস আগে জাকির ঢাকায় আসতে বললে সাইফুল ঢাকায় আসে। পরে জাকির সাইফুলকে বলে, একজন লোক আর্থিকভাবে তাকে অনেক বড় ক্ষতি করেছে, তাকে হত্যা করতে হবে। সাইফুল যদি ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে জাকির সাইফুলকে জায়গাসহ বাড়ি, অর্থ সহায়তা প্রদান করবে এবং আগের দেওয়া টাকা পরিশোধ করতে হবে না।

গ্রেফতার সাইফুল এবং জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, আনোয়ার শহীদকে হত্যার ধারাবাহিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১১ নভেম্বর সকালে জাকির ও সাইফুল দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে কল্যাণপুরে একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করেন।

হোটেলের কক্ষে বসে জাকির এবং সাইফুল ভিকটিমকে হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই দিন সন্ধ্যায় পূর্ব নির্ধারিত সময় এবং স্থানে ভিকটিম জাকিরের সঙ্গে দেখা করতে এলে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার জাকির এবং সাইফুল ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলে। রাতে জাকির সাইফুলকে ৬০০ টাকা দিয়ে দিনাজপুরে চলে যেতে বলে। নিজেকে সন্দেহ মুক্ত রাখতে ভিকটিমকে দেখতে হাসপাতালেও যায় সে। পরে দিনাজপুরে চলে যায়। পরে তাদের অভিযান চালিয়ে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।