বই উৎসবের বাকি আর দুদিন। এখন পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭৯ শতাংশ আর প্রাথমিকের ৬৪ শতাংশ বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হয়েছে দাবি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। যদিও মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি ঘাটতির পরিমাণ এনসিটিবির হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। কাগজ সংকটে প্রাথমিকের বই ছাপানো দেরিতে শুরু হওয়ায় সংকট বেশি ঘনীভূত হয়েছে। নিম্নমানের বইয়ের পাশাপাশি এবার প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থীর নতুন বই ছাড়াই বেশি কিছুটা সময় পার করতে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, আগামী ১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় পাঠ্যবই উৎসব উদযাপন করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের বই উৎসব গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হবে। আর প্রাথমিক পর্যায়ের বইয়ের কেন্দ্রীয় উৎসব হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। অনুষ্ঠানে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি, কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত থাকবেন।
এনসিটিবি সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই প্রায় ১০ কোটি। বাকি ২৫ কোটি মাধ্যমিক ও অন্যান্য বিষয়ের বই রয়েছে। বই উৎসবের আগে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০ শতাংশ বই জেলায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলেও প্রাথমিকের বড় অংশের বই পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রাথমিকের বই দেরি করে ছাপা শুরু হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, পার্সেজ কমিটির অনুমোদনে বিলম্ব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওপর প্রেস মালিকদের অসন্তোষসহ নানান কারণে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে।
‘গত ৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভায় প্রেস মালিকদের বিল দ্রুত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ৫ ডিসেম্বর থেকে প্রাথমিকের বই ছাপা শুরু করেন প্রেস মালিকরা। দ্রুত এ স্তরের বইয়ের কাজ শেষ করতে আমরা মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ বন্ধ করে শুধু প্রাথমিকের কাজ করতে প্রেসগুলোকে নির্দেশ দেই।’
তিনি বলেন, বর্তমান কাগজ সংকট ও সার্বিক পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রাথমিকের বই পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। প্রেস মালিকদের আমরা নানাভাবে বুঝিয়ে এ কাজে সফল হয়েছি। কাগজের সংকট নিরসনে গোডাউনে রাখা পুরোনো বই দিয়ে রিসাইকেল পাল্প তৈরি করে প্রেসগুলোতে কাগজ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এসব উদ্যোগের কারণে এ পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৭৯ শতাংশ আর প্রাথমিকের ৬৪ শতাংশ বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকি বই ১৫ জানুয়ারির মধ্যে পাঠানো সম্ভব হবে।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে হাওলাদার, আলামীন, মেরাজ, আমীন, সরকার অফসেট প্রিন্টিংপ্রেসসহ নয়টি ছাপাখানার নিম্নমানের বই-কাগজ চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করা হয়েছে। কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, দিগন্ত অপসেট ও নয়নমনি প্রিন্টিং প্রেসের কয়েক টন নিম্নমানের কাগজ শনাক্ত করে সেগুলো বাতিল করে এনসিটিবি। ব্রাইট, বারোতোপা, দশদিশা, সরকার গ্রুপসহ যে সব প্রতিষ্ঠান সক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ নিয়েছে তাদের কাজ আটকে গেছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এবার মাধ্যমিকের অষ্টম-নবম ও প্রাথমিকের চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ৮০ শতাংশ বই পৌঁছানো সম্ভব হলেও অন্যান্য ক্লাসের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বই পাঠানো সম্ভব হবে। কিছু বড় প্রেসে আগেই নিউজপ্রিন্টের কাগজে বই ছাপিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল সেগুলো এখন পাঠানো হচ্ছে। সে কারণে আগামী বছর শিক্ষার্থীরা নিম্নমানের কাগজে তৈরি বই হাতে পাবে। কাগজের উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশের নিচে থাকবে না বলে প্রেসগুলোকে শর্ত করা হলেও অধিকাংশ প্রেস মালিক সেটি মানছেন না।
তিনি আরও বলেন, দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করলেও বড় প্রেসগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এবছর এনসিটিবি যে সব নিম্নমানের বই নষ্ট করেছে তার অধিকাংশ ছোট প্রেসে তৈরি। বড় প্রেসে নিম্নমানের বই ছাপালেও রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, শর্ত ভঙ্গ করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর কারণে আমরা বেশ কয়েকটি প্রেসের তৈরি বই ও কাগজ নষ্ট করেছি। এরপরও কেউ লুকিয়ে খারাপ বই পাঠালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী বছর কাগজের সংকট কাটাতে বিদেশ থেকে এক লাখ টন ভার্জিন পাল্প আমদানি করা হবে। ২০২৪ সালের বই তৈরির দরপত্র আহ্বান করা হবে মার্চের মধ্যে।
এবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী বছর সব কিছু আগেই শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।