কক্সবাজারে টানা সাত দিনের অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন। এ সময় পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫০৩ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৫ লাখ টাকা।বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় কোথাও মহাসড়ক, সড়ক, কাঁচা রাস্তা, আবার কোথাও কালভার্ট ভেঙে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। অনেক স্থানে বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, বেড়িবাঁধ, ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে। চার দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের জন্য হাহাকার বাড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে।
তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বানভাসীদের মধ্যে ১০৩ টন চাল ও ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিতরণের তথ্য জানানো হলেও সেই ত্রাণ পানিবন্দী মানুষের কাছে পৌঁছেনি বলে অভিযোগ।
প্রশাসন জানায়, সেপটিক ট্যাংক থেকে বন্যার পরিষ্কার, বানের পানিতে ডুবে ও পাহাড় ধসে চকরিয়া, পেকুয়া, রামু ও উখিয়ায় গত চার দিনে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার সকালে পেকুয়ায় তিন শিশু ও চকরিয়ার থেকে দুজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া চকরিয়ায় ‘বন্যার পানিতে’ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়া সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় বাবা ও তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়।
জেলার চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের ফুলছড়ি বাসিন্দা মনির উদ্দিন বলেন, রাস্তা থেকে কালভার্ট সরে গেছে, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত, গাছপালা উপড়ে পড়ে বিধ্বস্ত রাস্তায় আটকে আছে। পানি নেমে যাওয়ায় ঘরে ফিরতে দেখি ঘর ভেঙে তছনছ। এখন চলাচলের রাস্তায় আটকে থাকা গাছ সরিয়ে নেব, নাকি ঘর ঠিক করব; কিছুই মাথায় আসছে না। তার ওপর খাবারের চিন্তাও করতে হচ্ছে।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা গফুর উদ্দিন জানান, চারদিন কমপক্ষে ৪-৫ ফুট পানিতে বন্দী ছিলেন তারা। পানি ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সড়কের ভাঙন, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান। যাদের বাড়িঘর এখনও রয়েছে, তাদেরও বাড়িতে গিয়ে রান্না করার সুযোগ নেই, বাড়ির ভেতরের পানি বের করার চেষ্টা করছেন।
বন্যাদুর্গত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেক পরিবারের ঘরে রান্নার চাল থাকলেও শুকনো লাকড়ি ও চুলার অভাবে রান্না করতে পারছেন না।
চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের ফুলছড়ি গ্রামে নুরুল আমিনের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৫) বলেন, বন্যায় খুব দুর্ভোগে আছি। রান্না করার উপায় নাই। ঘরে শুকনো খাবারও নাই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঁচার উপায় থাকবে না।
মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি সৈয়দ আলম বলেন, ঘেরে কয়েক লাখ টাকার পোনা ফেলেছিলাম; কিন্তু বন্যায় ভেসে গেছে সব। এখন ঘর নিয়ে চিন্তা করব, নাকি ঘের নিয়ে চিন্তা করব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
রশিদ আহমদ নামে এক কৃষক বলেন, দুই একর জমিতে ধানের চাষ করেছি। কিন্তু বন্যায় সব শেষ।
এবার বন্যায় পানিতে ডুবে যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া স্টেশন। আর স্টেশনের দু’পাশের অসংখ্য মার্কেট ও দোকানপাট তলিয়ে যায় বন্যার পানিতে।
এ বিষয়ে চকরিয়া-পেকুয়ার স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, এবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা প্রত্যক্ষ করল চকরিয়াবাসী। গত ৫০ বছরেও এমন বন্যা দেখেনি তারা। ভয়াবহ এ বন্যায় চিংড়ির ঘের, ক্ষেত-খামার, বাগান, ঘরবাড়ি থেকে শুরু রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আর চকরিয়া স্টেশনের পানিতে মার্কেট ও দোকানপাটের দুই কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এ ক্ষতি সীমাহীন। তারপরও এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য চকরিয়া ও পেকুয়াবাসীর সবসময় পাশে রয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।
জানা গেছে, কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি এক কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বন্যায় নির্মাণাধীন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেললাইনের বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫৯ কি.মি সড়ক বিধস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, বন্যায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বেশ কিছু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের কিছু জায়গায় রেললাইন পানির নিচে চলে গেছে। বন্যায় রেললাইনের পাথর, মাটি ও বাঁধ ভেসে গেছে। কিছু অংশে রেললাইন হেলে পড়েছে। এবারের ক্ষতি এ প্রকল্পের জন্য গুরুতর ধাক্কা এবং এ ক্ষতির কারণে প্রকল্প শেষ হতে দেরি হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভূমিধস ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১৮ জন। বন্যা দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ১৫ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকা ও ১০৩ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।