বাংলা সন ১৪৩২ এর প্রথম দিন আজ। বাংলা বছরের প্রথম দিন, অর্থাৎ বৈশাখের ১ তারিখ, বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। শুধু উৎসব নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। পহেলা বৈশাখ, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় বাংলা নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।

বাংলা নববর্ষ উৎসবের কেন্দ্রস্থল ঢাকা শহরের রমনা বটমূল, যেখানে ভোরে ছায়ানটের শিল্পীরা গান গেয়ে নববর্ষকে আহ্বান জানান। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাঙালি সংস্কৃতির চিত্রপট যেন রাস্তায় নেমে আসে। রঙিন মুখোশ, বিশালাকৃতি পশুপাখির প্রতিকৃতি, পুতুল ও ধ্বনির সঙ্গে এগিয়ে চলে হাজারো মানুষ।

২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে ঘোষণা করে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’। যদিও এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে রাখা হয়েছে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, এবার পহেলা বৈশাখে বের হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পয়লা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে দেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে।

নতুন বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে সরকারি ছুটি হওয়ায় সবাই নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দিনটিকে ঘিরে এ বছর রাজধানীতেও নানা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বাঙালি সমাজের কৃষিসভ্যতার সূচনাকাল থেকেই বাংলা সনের উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সমাজ বিকাশের ধারায় সেভাবেই বাংলা সনের সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাংলার ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা কেন করেননি সে একটা গুরুতর প্রশ্ন। তবে বাংলা সন ঠিক কখন, কীভাবে প্রচলিত হয়েছিল তা এখনো একেবারে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। তবে নানা পরোক্ষ প্রমাণে মনে করা হয়Ñসম্রাট আকবর এই সন প্রবর্তন করেন।

সম্রাট আকবর যদি সরাসরি বাংলা সন প্রবর্তন না করে থাকেন, তবু এর প্রচলনে যে তার পরোক্ষ অবদান আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সম্রাট আকবর সর্বভারতীয় ইলাহিন সন প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলা সন সেই ইলাহিন সনের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই প্রচলিত হয়েছে। সে জন্যই অধিকাংশ সন-গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলা সন সম্রাট আকবর বা কোনো মুসলমান রাজা-বাদশা বা সামন্ত প্রভু প্রচলন করেছিলেন। এদের মধ্যে উড়িষ্যার বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাশিপ্রসাদ জয়সোয়াল মনে করেন আকবরই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা মনে করেন, আকবরের তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন। হলো বঙ্গাব্দের মূলে। অন্যদিকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও তার মিলেনিয়াম বক্তৃতায় (নয়াদিল্লি ২০ আগস্ট ১৯৯৮) সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করেন। সন তারিখের ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন এমন একজন ধীমান গবেষক পলাশবরণ পাল বাংলা সনের নানা সমস্যা নিয়ে বিতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন: কুড়ি পঁচিশ বছরের আগে বঙ্গাব্দ’ শব্দটার চল ছিল না, তখন বলা হতো শুধুই ‘সাল’ বা ‘সন।

পশ্চিম ভারতে কেউ বিক্রম সংবৎকে ‘বিক্রম সাল’ বা ‘বিক্রম সন’ বলে না। নেপালে বুদ্ধ সংবৎকে কেউ বুদ্ধ সাল বলে না। তাহলে বাংলায় ‘সাল’ বা ‘সন’ বলা হয় কেন? এখানে মনে রাখতে হবে, সাল কথাটা ফার্সি, সন কথাটা আরবি। এ থেকে মনে হয়, হিজরি ক্যালেন্ডার থেকেই কোনোভাবে উদ্ভূত আমাদের বাংলা অব্দ বা বাংলা সাল। তা যদি হয়, তাহলে ‘আকবর থিয়োরি’র চেয়ে বিশ্বাস্য অন্য কোনো থিয়োরির সন্ধান পাওয়া মুশকিল (সাল তারিখের ইতিহাস-পলাশবরণ পাল, পৃ. ৯৫, সমতট প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৪)।

এক শ্রেণির গবেষক সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ককে ‘বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে দাবি করেন। আবার কেউ কেউ বাংলার সুলতানি আমলের বিখ্যাত স¤্রাট হোসেন শাহকে বাংলা সনের প্রবর্তক বলে মনে করেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ভূতপূর্ব কারমাইকেল অধ্যাপক ও মধ্য এশিয়ান ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন : …এটা পরিষ্কার যে আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ ব্যবহারের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও আলোচিত তথ্যাদি আকবরের আমলে চান্দ্র-হিজরি অব্দের সংস্কারের মধ্যেই বঙ্গাব্দের সূচনার ইঙ্গিত করে। এর বিপরীত কোনো ঘটনা নির্দেশক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্র আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই মতোই গ্রহণযোগ্য (বাঙ্গালা সন : বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ৮৭, কলকাতা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০০)।

বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের উদ্ভবের বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও বাঙালির ইতিহাস ও তাদের জীবনযাত্রায় এ সনের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও গভীর। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী সব কর্মকাণ্ডে বাংলা সনের ছিল একমাত্র আধিপত্য। ভারতের নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বিকশিত কৃষি সভ্যতার সঙ্গে ঋতুভিত্তিক কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা ও তার হিসাব-নিকাশের সঙ্গে পঞ্জিকার সম্পর্ক নিবিড় ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন, তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। সেই সঙ্গে ভালো ফসল ঘরে উঠলে বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণও উদযাপিত হতো বাংলা পঞ্জিকার দিনক্ষণ হিসাব করে। বাংলায় হরেক রকম মেলার দিন তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সাথে-শুধু ফসল আর উৎসব না, বাঙালির অর্থাৎ বাঙালি কৃষকের পারিবারিক এবং সামাজিক কাজকর্ম, শুভাশুভ, বিবাহ, জনমৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য।