আজ ২৫শে বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২ তম জন্মজয়ন্তী। বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের কাছে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যময়। জীবনের সুর আর ছন্দ, বিচিত্র ভাবের সম্মিলনে ওঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে। মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গ নিপুন দক্ষতায় শিল্পের বিষয় করেছিলেন তিনি। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ বড় অবলম্বন বলে মনে করেন অনুরাগীরা।
কালজয়ী এ কবি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্ম নেন। সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় শৈশব থেকেই নানা গুণ প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ ঘটে তার জীবনে।
বাঙ্গালীর জীবনে যে নামটি কখনোই অতীত হবে না। বাঙালীর জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজেকে স্থাপনকরে তার সুখ,দু:খ ভালোমন্দের ছবি এঁকে, তাদেরই আপনজন হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাইতো আজো সাড়ম্বরে পালন করতে হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী।
সৃষ্টির বিচারে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের কবিগুরু, বিশ্বসাহিত্যের মহীরূহ। নির্ঝরের মতো চলেছে তার লেখনি। কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, চিত্রকর কিংবা সঙ্গীত স্রষ্টা, এমনই বহুবিধ পরিচয় তাঁর। আর সকল পরিচয়েই তিনি সৃজনশীল ও গভীর অন্তর্দর্শী। তাঁর সৃষ্টি আজো আমাদের মাঝে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস যুগিয়েছে। এ কারণে তার রচিত “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” ও “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গান দুটি যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
বাংলা সাহিত্য ও উপন্যাসে এক ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লেখার মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের অবিচার, অসংগতি, ভালোবাসা, অনুভূতির গভীর প্রকাশ। প্রেম ভালোবাসার সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভালোবাসাকেও একই সুতায় গেঁথে মালা তৈরি করার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, তরুণরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। মনের অভিব্যক্তি আর নানা ভাবনা বিস্তৃত করে তাই কবি নতুনদের আহ্বান জানিয়েছেন তার লেখায় শতবার। লিখেছেন, ‘হে নূতন/ দেখা দিক আর বার/ জন্মের প্রথম শুভক্ষণ/ তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/ সূর্যের মতন’।
কবির লেখা জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ, শ্রেণিবৈষম্য, জাতিতে জাতিতে ও ধর্মে ধর্মে হানাহানির সংকীর্ণতাকে এক পাশে রেখে মানবজাতিকে আলোর পথ দেখায়। একই সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয়গুলোকে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে নতুন করে।
কবির কিছুর বৈচিত্র্যময় উল্লেখযোগ্য লেখা হলো শেষের কবিতা, নৌকা ডুবি, ঘরে বাইরে, নষ্ট নীড়, স্ত্রীর পত্র, সুভা, গীতাঞ্জলী, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, রক্তকরবী, চিরকুমার সভা, বিসর্জন, চিত্রাঙ্গদা, গীতবিতান ইত্যাদি।
তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় কিছু গান হলো আমারও পরাণও যাহা চায়, আমি চিনিগো চিনিগো তোমারে ওগো বিদেশিনি, চাঁদের হাসি বাধ ভেঙেছে, ভালোবাসি ভালোবাসি, তুমি রবে নীরবে, তোমার খোলা হাওয়া, আকাশ ভরা সূর্য তারা, আমার সকল দুঃখের প্রদ্বীপ, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ইত্যাদি।
কবিকে তাঁর লেখায় প্রায়ই আত্মসমালোচনা করতে দেখা গেছে। ব্যক্তিজীবনে নিজেকে ফাঁকি দিলেও নিজের লেখায় কখনও ফাঁকি দেননি রবীন্দ্রনাথ। তাই সমাজের বেঁড়াজালে যা করে উঠতে পারেননি তারই শক্ত জবাব হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলমের ক্ষুরধার লেখা।
২৫ শে বৈশাখের এই দিনে তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আবারও নতুন করে প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে, চিন্তার জগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটাক। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যুগিয়ে বিশ্বকবি চির জাগ্রত থাকুক প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।