ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পরিকল্পিত রুট পরিবর্তন করেন। সেদিন তিনি ভিন্ন পথে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান। ভাষণের পরে ফেরার পথেও একই কায়দায় বেশ কিছু এলাকা ঘুরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন। ভিন্ন রুটে যাওয়া-আসা করায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লেগেছিল।

ঐতিহাসিক ওই দিনটিতে ভোর থেকেই চারদিকে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরদারি, আকাশে হেলিকপ্টারের টহল, কমান্ডো হামলার আশঙ্কা– এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এমনটি করা হয়েছিল। সেই সময়কার দায়িত্বশীলদের বয়ানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির চালক তার ফুফাতো ভাই মরহুম মমিনুল হক খোকা, বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি থেকে রেসকোর্স ময়দান এবং সেখান থেকে ধানমন্ডিতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান সাবেক ছাত্রনেতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর তোফায়েল আহমেদ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরুর (ওরা ১১ জন ছবির নায়ক) বয়ানে জানা যায় সেদিনের কথা।

সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক ২০১১ সালে একটি গণমাধ্যমকে ৭ মার্চ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার নানা ষড়যন্ত্র চলছিল উল্লেখ করে স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন, ‘শোনা যাচ্ছিল, কমান্ডো হামলা হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে রেসকোর্সে ভাষণের আগে-পরে বঙ্গবন্ধুকে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে সেই দায়িত্ব ছিল আমার।’ ধানমণ্ডি থেকে রেসকোর্স হয়ে ফের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পরই স্বস্তিবোধ করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেছিলেন রাজ্জাক।

তিনি জানান, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে সমাবেশস্থলে আনা-নেওয়ায় বিশেষ কৌশল নিতে হয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পিত যাত্রাপথ পাল্টে বঙ্গবন্ধুকে আনা হয় রেসকোর্সে। ভাষণের পরেও বদলাতে হয়েছিল পথ।

৭ মার্চের সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন– এমনটি জানিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চ রেসকোর্সে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করি। ঠিক হলো, তিনটি গাড়ি আমাদের সঙ্গে রেসকোর্সে যাবে। দুটিতে থাকবেন তারা যাদের গোঁফ আছে এবং তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি। চুল থাকবে ব্যাক ব্রাশ করা। সামনের গাড়িতে আমরা। ঠিক ২টার সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু।’

স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। কোনও অঘটন ঘটে কিনা! তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র চারদিকে। বলা হয়েছিল, কমান্ডো অ্যাটাক করে হত্যা করা হবে। আকাশে হেলিকপ্টারও ঘুরছে। অ্যাটাক হলে বাঁচানো যাবে না। ৩২ নম্বর থেকে এলিফ্যান্ট রোড, তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার কথা। যাত্রার শুরুতেই তাৎক্ষণিকভাবে আগের সব পরিকল্পনা বদলে ফেলি। আমি কৌশলটা নিলাম, যেভাবে যাওয়ার কথা ওভাবে যাবো না। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের গাড়িতে তুললাম। গাড়ির ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে রেখে আমরা এমনভাবে দাঁড়ালাম যাতে তাকে দেখা না যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রওনা দিলাম নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে রেসকোর্সের পথে। বিশাল জনতার ঢেউয়ের মধ্যে সোজা মঞ্চে উঠলেন তিনি। পেছনে দাঁড়িয়ে মহিউদ্দিন, আমি আর গাজীউল হক। সমাবেশে কেউ সভাপতি ছিলেন না।’

সেখানে গিয়েই বঙ্গবন্ধু মাইকটা চেয়ে নিলেন বলে জানান আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ‘জয় বাংলা,’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দুটি দিতে দিতেই বঙ্গবন্ধুকে মাইক দেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর রাজ্জাক তার স্মৃতিচারণে বলেন, ‘আমার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আশঙ্কার। কারণ, মাথার উপরে তখনও হেলিকপ্টার ঘুরছে। ভাষণ দিয়ে নেমেই বঙ্গবন্ধু সোজা ওঠেন গাড়িতে। কেউ জানে না, আমরা কোন দিকে কোথায় যাচ্ছি। আগের পরিকল্পনা পাল্টে সেই একই কায়দায় সমাবেশস্থল থেকে শাজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির পাশ দিয়ে শেরেবাংলা নগর হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। স্বস্তি পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুকে একেবারে, সঠিকভাবে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পেরে।’

বঙ্গবন্ধুর মেজো ফুফুর ছোট ছেলে মমিনুল হক খোকা রাজনৈতিক জীবনের প্রায় শুরু থেকেই তার নিত্য সহচর। কলকাতা-জীবন শেষ করে ঢাকায় এসে মোগলটুলীতে আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েকটা দিন কাটানোর পর আরমানিটোলার রজনী বোস লেনে মমিনুল হক খোকার মেসেই উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সারাজীবনের স্মৃতি খোকা তুলে ধরেছেন ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল/ বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ বইতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মিঞাভাই দোতলা থেকে নেমে এসে উঠলেন আমার গাড়িতে, আমি চালক। পেছনে ট্রাকে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। চিন্তামগ্ন মিঞাভাই। গোটা জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে তিনি আজকে কী বলবেন তার ওপর। ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্সে পৌঁছাতে যে সময় লাগে তার দ্বিগুণেরও বেশি সময় নিয়ে রেসকোর্সে এসে পৌঁছালাম।’

বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে রেসকোর্সে নেওয়ার বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় কামরুল আলম খান খসরুর লেখায়। ২০১৬ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার ভাষ্য মতে, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনটি দল গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে আনা-নেওয়ার জন্য গঠিত দলে ছিলেন খসরু, মন্টু (মোস্তফা মহসীন মন্টু), হোসেন, মুরাদ, নাজিম, বাচ্চু, শান্ত প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় মঞ্চের নিচে অবস্থানের জন্য একটা দল রাখা হয়। সে দলে ছিলেন আফজাল হোসেন ভুলকু, হালিম, বাবুল, বাচ্চু, বাবলা, মধু, সেলিম, দিলু, জয়নাল প্রমুখ। মঞ্চের আশপাশে সার্বক্ষণিক থাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত দলে ছিলেন মুরাদ, হোসেন, নাজিম, আলিমুদ্দীন, জুডোমনি, আওলাদ, আবু, নেহাল, সেলিম ভূঁইয়া, ইকবাল, ফিরু, জিয়া, পারভেজ রংপুরী প্রমুখ। খসরু লিখেছেন, ‘রাজ্জাক ভাই পুরো মঞ্চের দেখভালের দায়িত্ব দেন আমার ওপর। মঞ্চের ওপর কে কে উঠবে তাদের নাম আমার কানে কানে বলেন। এর বাইরে কোনও ব্যক্তি যাতে মঞ্চে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করেন।’

ঘুরপথে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্সে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল আহমেদও। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্ন পথে তাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা কালো কোট পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত হয়েছিলেন। মঞ্চে সকাল থেকেই গণসংগীত চলছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন একাই ভাষণ দিয়েছিলেন।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।