আজ ২৯শে সেপ্টেম্বর। কক্সবাজারের রামু ট্রাজেডির ১০ বছর। ২০১২ সালের আজকের এইদিনে সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে আলোচিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল।
যেদিন উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডিতে কোরআন শরীফ অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগ তুলে উস্কানিমূলক মিছিল সহকারে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা চালিয়ে বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৩টি বৌদ্ধ বিহার এবং ৩০টি বসত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫ থেকে ১৬ হাজার জনকে আসামি করে ১৮টি মামলা করে। পরবর্তীতে এসব মামলায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ১০ পার হলেও এখনো পর্যন্ত একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধরা এ হামলার আর বিচায় চায় না! তাই মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসে না আদালতে।
তারা বলেছেন, এখন বিচারের নামে নিরপরাধ কোন ব্যক্তি হয়রানি হোক তা চান না তারা। তারা চান শান্তি ও সম্প্রীতি।
এ বিষয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল, মিটিং হয়েছে। অনেকেই চেনা গেছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তাতে অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছে তেমনি নিরপরাধ অনেকেই হয়রানি হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ শান্তির ধর্ম। এখনে সকলেই শান্তি চান।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক ভিক্ষুক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা ঘুচিয়েছে। এটা ধারাবাহিক রক্ষা করা জরুরি। বিচারের নামে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা জরুরি। এটা করতে গিয়ে নিরপরাধ কেউ হয়রানিতে শিকার হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়।
কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৯টি। এরমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ১৮টি মামলা করেন। অপর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীতে বিবাদীদের সঙ্গে আপোষনামা দিয়ে খালাস করেছেন। বিচারাধীন ১৮টি মামলায় সাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা।
তিনি বলেন, ‘সাক্ষীরা আমাদের বলেছেন, তারা এসব মামলার বিচার আর চায় না। কারণ পুড়ে যাওয়া মন্দিরের স্থলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্মাণ করে দেয়া মন্দিরগুলো তাদের বেশি সন্তুষ্ট করেছে। শেখ হাসিনা যা দিয়েছেন তা হারানোর চেয়ে অনেক বেশি। তাই হামলাকারীদের বিচার না হলেও তাদের কোনো দুঃখ নেই!’
তবে বিচারিক কাজে দীর্ঘসূত্রিতা দেখে অনেকটা নিরাশ কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। তিনি এ জন্য মামলার রাষ্ট্রপক্ষ এবং সাক্ষীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলেছেন, মূলত হামলার সাথে জড়িত অনেককে মামলার আসামি করা হয়নি। আবার নিরপরাধ অনেককে আসামি করা হয়েছে। তাই বিচার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের মাঝে অনিহা তৈরি হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রামু- উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধমন্দির ও বসতি পোড়ানোর এই সহিংসতার ঘটনায় এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের করা হলেও পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৪৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। তার মধ্যে একটি আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, দুটি পুনঃতদন্তধীন রয়েছে। ১৬টি বিচারাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে সেই বর্বর হামলার ১০ বছর পর ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধপল্লীর বর্তমান অবস্থা জানতে সরেজমিনে দেখতে গেলে সেখানেও আলাপকালে তারা জানান, আধুনিক স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত সুরম্য মন্দির পেয়ে বেশ খুশি বৌদ্ধরা। তাদের মনে যে ক্ষতের দানা বেঁধেছিলো তা বহুলাংশে মুছে গেছে। তারা এখন প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তবে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাধারণ বৌদ্ধরা শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ সাধনানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘১০ বছরের মাথায় এসে বৌদ্ধরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সেই বিভৎস্য ঘটনার প্রভাব কেটে গেছে। কিন্তু এত বড় বর্বর ঘটনা কখনো ভোলার নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে রেশ রয়েই গেছে; থাকবেও আজীবন। তবে বিচার প্রাপ্তি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মনে।’
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি রামু উপজেলা শাখার সভাপতি সুরেশ বড়ুয়া বলেন, ‘২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ রামুবাসীর জন্য একটি ‘কালো রাত’ ছিলো। এই নৃশংস ঘটনাটি রামু সম্প্রীতির জায়গায় বড় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকল্পনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তারপরও আমাদের শত শত বছরের পুরনো স্থাপত্যশিল্পগুলো আর ফিরে না পাওয়ার যে একটা বেদনা তার দাগ মনে রয়ে গেছে।’
রামু মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উজ্জ্বল ক্ষেত্র হিসেবে শত বছর ধরে রামুর বেশ সুনাম রয়েছে। ২০১২ সালের ঘটনার পর সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্পর্কে বিরাট ছেদ পড়েছিলো। কিন্তু ফাটল জোড়া দিয়ে আবারো সম্প্রীতির ছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে চিরাচরিত স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে রামুবাসী।
এই প্রসঙ্গে রামু উপজেলার শিক্ষক-সাংবাদিক ও লেখক মাওলানা আবুল মঞ্জুর বলেন, ‘সেই ঘটনাটি ছিলো অপ্রত্যাশিত। এমন ঘটনা কখনো কাম্য নয়। যে ঘটনা রামুর শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বুকে বড় আঘাত হেনে ছিলো। তবে সেটা কাটিয়ে আমরা আবারো অসাম্প্রদায়িকতার ছায়ায় অবস্থান নিয়েছি। আর কখনো যাতে এমন বর্বর ঘটনা না ঘটে এটা কামনা করি।’
তিনি বলেন, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অনেক নিরাপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।আবার হামলায় জড়িত থেকেও পার পেয়ে গেছে অনেকে। এই নিয়ে খোদ ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝেও ক্ষোভ রয়েছে।
এই বিষয়ে রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া বলেন, ‘কেন মন্দির পোড়ানো হয়েছে সেটি আমরা এখনো জানি না। সেদিন অনেক নিরপরাধ মানুষও আসামি হয়েছে। আবার অনেক অপরাধী পার পেয়েছিল। এনিয়ে একটা সংশয় রয়েই গেছে। তারপরও আমরা চাই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে রামুর সম্প্রীতি ধরে রাখতে।’
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম বলেন, ‘বৌদ্ধমন্দির ও পল্লীর হামলাটি মানবতার চরমবিরোধী। ইতিহাসে এমন বর্বর ঘটনা বিরল! সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ এতে ছাড় দেবে না। কারণ এমন বর্বর ঘটনার বিচার না হলেও মানবতার প্রতি চরম অবিচার করা হবে। একই সাথে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই যে কোনো মূল্যে এই ঘটনার শেষ করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার একটি ছবি ট্যাগকে কেন্দ্র করে রামুতে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ঘটনা। পরে রাতের অন্ধকারে রামুতে ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ৩০টি বসতঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুস্কৃতিকারীরা। কিন্তু সেই থেকে সেই উত্তম বড়ুয়া নিরুদ্দেশ রয়েছে!
পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে একইভাবে উখিয়া ও টেকনাফে ৭টি বৌদ্ধ বিহার ও ১১টি বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিহার ও ঘরবাড়িগুলো নতুন কারুকাজে পুনর্নির্মাণ করে দেয়া হয়।