নন্দিত কথাসাহিত্যিক, জনপ্রিয় নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের চিত্রকর্ম আত্মসাতের অভিযোগে দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

২৯ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে শাওন মামলাটি করেন। মামলার দুই আসামি হলেন- রুমা চৌধুরী নামের এক নারী ও তার সাবেক স্বামী পুস্তক ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ সাহা। অভিযোগের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য পাঠিয়েছেন বিশ্বজিৎ সাহা। নিচে হুবহু তার বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

হুমায়ূন আহমেদের কোনো চিত্রকর্মের প্রদর্শনী বা তার কোন চিত্রকর্ম চুরি হওয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। হুমায়ূন আহমেদের ২৪টি চিত্রকর্মের মধ্যে ২০টি তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করেছি ২০১৩ সালে। ১টি ছবি মেলার স্থান থেকে হারিয়ে যায়। যা জ্যামাইকার পুলিশ প্রিসিংকট জিডি করে, তাও হুমায়ূন আহেমদ এর মায়ের কাছে হস্তান্তর করি। এছাড়া ১টি চিত্রকর্ম হুমায়ূন আহমেদ জাতিসংঘে নিযুক্ত তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনকে উপহার দেন। আরেকটি বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে উপহার দেয়া হয়।

২৪নং ছবিটি উপহার দেন হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাব্বির আহমেদকে। হুমায়ূন আহমেদের আকা সকল ছবি ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত বাংলাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের শেষদিনগুলি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মায়ের কাছে চিত্রকর্মগুলো হস্তান্তরের ৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এতদিন পর আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে মামলা দায়ের করে শাওন হুমায়ূন আহমেদের সম্মান বা মর্যাদা কিভাবে বৃদ্ধি করলেন এ প্রশ্ন যাদের মনে উদয় হবে এর উত্তরও নিশ্চয় তারাই খুঁজে নেবেন।

হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবি আত্মসাতের অভিযোগে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাওন মামলা করায় আমি অবাক হইনি। অবাক হইনি মামলার নথিপত্রে তার মিথ্যাচার দেখেও। শাওন অভিযোগ করেছেন, ২০১২ সালে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় থাকাকালে অবসরে হুমায়ূন আহমেদ বেশ কিছু ছবি আঁকেন।

সে সময়েই নাকি তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। হুমায়ূন আহমেদ যেদিন বেলভিউ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সেদিন সকালে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও মিথ্যা বলেছিলেন শাওন। তিনি বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে উঠছেন, তাকে বাসায় নিয়ে আসা হবে। সাক্ষাৎকারে তার এই কথা বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের অকাল প্রয়াণ ঘটে।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কখন থেকে আমার পরিচয় তা শাওনের জানার কথা নয়। ১৯৯৪ সাল থেকে যতবার হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে এসেছেন, প্রধানত আমার সাংগঠনিকতায় মুক্তধারা নিউইয়র্ক ও নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলাকে ঘিরেই ছিল তার সকল আনন্দ-উদযাপন। শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয়েরও অনেক আগের ঘটনা সেটা।

১৯৮৫ সালে আমি যখন মোস্তফা জব্বার সম্পাদিত সাপ্তাহিক আননন্দপত্রে কাজ করি, তখন থেকেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ কথাও শাওনের জানা যে, চিকিৎসা নিতে নিউইয়র্কে এসে হুমায়ূন আহমেদ আমারই তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় স্বজ্ঞানে তিনি হাসপাতালসহ সর্বত্র আমার ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন। এমনকি তার মৃত্যুর আগে ও পরে বেলভিউ হাসপাতাল থেকে যে বিল এসেছিল তার অর্থ আমিই হুমায়ূন আহমেদের ডেথ সাটিফিকেটসহ জমা দিয়ে মওকুফ করার ব্যবস্থা করেছি। এসব কথা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন শাওন।

হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবিগুলো আত্মসাৎ করার যে লক্ষ্য তার ছিল তা আমি হতে দিইনি বলেই তার যত উষ্মা। হুমায়ূন আহমেদের মা আয়শা ফয়েজ জীবিত থাকাকালে মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ তার অন্যান্য পুত্র-কন্যাদের উপস্থিতিতে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের মিরপুরের পল্লবীর বাসায় গিয়ে ১টি ছাড়া হমায়ূনের আঁকা অন্য সবগুলো চিত্রকর্ম তার কাছে হস্তান্তর করি। আমার এই পদক্ষেপের কারণে শাওন হমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবিগুলো গ্রাস করতে পারেননি, সেটাই আমার অপরাধ। আমার লেখা হমুায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো প্রকাশিত হওয়ায় নিউইয়র্কের বেলিভউ হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসায় যে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি সে খবর জানাজানি হয়ে যাওয়ায় মানুষের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করতে শাওনের অসুবিধা হয়ে পড়ে। আমার লেখা বইটির প্রকাশনা রুদ্ধ করতে সেই ক্ষোভেই মরিয়া হয়ে শাওন মামলা করেছিলেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, নিউইয়র্কের পত্র-পত্রিকায় শাওনের বিভিন্ন কেলেংকারীর খবর প্রকাশিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের কয়েকজন লেখক-বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সম্মান ক্ষুন্ন না করার অজুহাত তুলে তিনি এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

আরও মর্মান্তিক ঘটনা হচ্ছে, চেয়ার থেকে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের সেলাই খুলে যাওয়ার ঘটনা জানতে পেরে রুষ্ট হয়ে একজন হুমায়ূনপ্রেমী চট্টগ্রাম থেকে মামলা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে তাকেও বিরত রাখা হয় হুমায়ূন আহমেদের সম্মান ক্ষুন্ন হবে এ অজুহাত তুলে। আমি পরিস্কার ভাবে বলতে চাই, শাওনের হাতে না দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের চিত্র প্রদর্শনীর সব ছবি হুমায়ূনের পরিবারের সকলের অভিভাবক হিসেবে তার মায়ের কাছে আমি নিজ হাতে হস্তান্তর করে এসেছি।