মালয়েশিয়ায় জোরপূর্বক শ্রম ও মানবপাচার বন্ধে গাইডলাইন তৈরি করেছে দেশটির সরকার এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। দেশি বা বিদেশি শ্রমিক বা কর্মীকে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করলে বা এ উদ্দেশ্যে পাচার করলে মালয়েশিয়ার পুলিশ, শ্রম দফতর, মানবপাচার প্রতিরোধ কাউন্সিল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং নির্ধারিত বেসরকারি সংস্থায় রিপোর্ট করা যাবে। কিউ আর কোড স্ক্যান করলে নাম জানা যাবে।
সংস্থাগুলো কর্মীর বিষয়ে কীভাবে কাজ করবে এবং তথ্য ও কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করবে সে বিষয়ে গাইডলাইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। ফ্রন্টলাইন পরিষেবা সরবরাহকারীরা গাইডলাইন অনুযায়ী পাঁচটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন। প্রক্রিয়াগুলো হলো- সম্ভাব্য মামলার প্রতিবেদন করা; সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই, ভুক্তভোগীর চাহিদা মূল্যায়ন, মামলার রেফারেল তৈরি এবং মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া।
প্রতিটি অপরাধ সম্পর্কে গাইডলাইনে সুস্পষ্টভাবে বলা রয়েছে। গাইডলাইনে মানবপাচার সম্পর্কে মালয়েশিয়ার অ্যান্টি- ট্রাফিকিং ইন পারসন অ্যান্ড অ্যান্টি স্মাগলিং অব মাইগ্রেন্ট আইন ২০০৭- উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাক্তিকে জোর জবরদস্তিমূলকভাবে নিয়োগ করা, পৌঁছে দেওয়া, স্থানান্তর করা/পরিবহন করা, আশ্রয় দেওয়া/কোথাও রেখে দেওয়া এবং গ্রহণ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য।
এছাড়াও এ উদ্দেশ্যে বল প্রয়োগ করে বা হুমকি দেওয়া, জোর জবরদস্তি করা, অপহরণ করা, প্রতারণা করা, ভুল তথ্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা, দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া ইত্যাদি যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, তা মানবপাচার এবং অভিবাসী স্মাগলিং সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে মর্মে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বিভিন্ন এনজিও বিভিন্ন সময় আওয়াজ তুলেছে।
জবরদস্তিমূলক শ্রমের বিষয়টি সম্পর্কে গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে, যে সব কাজ বা পরিষেবা/সার্ভিস যা কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা ভয় দেখিয়ে বা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে জোর করে নেওয়া হয় এবং যার জন্য কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সম্মতি দেয় না, তা ফোর্সড লেবার হিসেবে চিহ্নিত। এ ধরনের ঘটনার সত্যতা পেয়েছে আমেরিকা ও ইউকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গাইডলাইনে উল্লিখিত ২২টি বিষয়ের মধ্যে যেকোনো একটি দেখলেই বা নিজের ক্ষেত্রে ঘটলে কোড স্ক্যান করে তথ্য দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তথ্য দাতার তথ্য গোপন রাখার শর্ত রয়েছে।
গাইডলাইনে যে ২২টি বিষয়ের কথা বলা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো : কর্মক্ষেত্রের প্রকৃতি (কাজ, বেতন, আবাসন ও নিরাপত্তা) এবং শর্ত সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া (বিদেশি কর্মীদের ক্ষেত্রে দেশে এরূপ করা হয়েছে), পাসপোর্ট, আইনি বা অন্যান্য মূল্যবান কাগজপত্র আটকে রাখা, শারীরিক বা যৌন নির্যাতন/সহিংসতা, সংবেদনশীল শব্দ বা মৌখিক/কথার দ্বারা নির্যাতন, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংসতার হুমকি, কাগজ-পত্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে (পুলিশ বা ইমিগ্রেশন) জানানো বা ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, বাড়িতে ফেরত পাঠানোর হুমকি, কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করার হুমকি, ঋণ বা ধার-দেনা করলে তা বৃদ্ধির হুমকি, কালো তালিকাভুক্ত (ব্ল্যাক লিস্ট) করার হুমকি দেওয়া, অনুপযুক্ত শর্তাদির জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা নিয়োগকারীদের অর্থ প্রদান, অতিরিক্ত রিক্রুটিং ফিস দেওয়া, বেতন আটকানো, অন্যায়ভাবে বেতন থেকে টাকা কাটা, অবরুদ্ধ রাখা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, অতিরিক্ত কাজ করানো, ছুটির দিন উপভোগ করতে না দেওয়া বা ছুটি নেওয়ার অনুমতি না দেওয়া, জীবনযাত্রার অবনতি ঘটানো এবং পর্যাপ্ত খাবার না দেওয়া।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী নিজে এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করে উপরোক্ত বিষয়গুলো অনেক আগে থেকেই যাচাই করছেন। উল্লিখিত ২২টি বিষয়ের মধ্যে অতিরিক্ত শ্রম, বেতন কম, ওভারটাইম না পাওয়া, ছুটির দিনেও কাজ করা, ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে আসা, অতিরিক্ত রিক্রুটিং খরচ দেওয়া, দেশে নিয়োগের সময়ে যে কাজের ও বেতনের কথা বলা হয়েছিল তার সাথে মিল না থাকা, দালাল এবং বাসস্থানের খারাপ অবস্থার তথ্য আমেরিকা এবং ইউকের ইউনিভার্সিটি নিউ ক্যাসলের গবেষণায় উঠে এসেছে।
ফলে আমেরিকা মালয়েশিয়ার পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য অনুসরণ করে। এর ফলে মালয়েশিয়ার প্ল্যান্টেশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের উৎপাদক ও বিনিয়োগকারীরা চরম বিপদ মোকাবিলা করছেন। ইতোমধ্যে টপ গ্লোভ, হার্টালেগাসহ অন্যান্য কোম্পানি নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত খরচের অতিরিক্ত অর্থ কর্মীদের ফিরিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সম্প্রতি জহুর প্রদেশের পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর বাসস্থান এবং অতিরিক্ত রিক্রুটমেন্ট খরচ নিয়ে আপত্তি তুলে আমেরিকা পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়াকে টায়ার ৩-এ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে মালয়েশিয়া সরকার খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। সাম্প্রতিক গাইডলাইনটিই তার প্রমাণ। ইতোমধ্যে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় ওয়ার্ক ফর ওয়ার্কার্স নামে একটি অনলাইন অ্যাপ চালু করেছে, যার মাধ্যমে দেশি বিদেশি নির্বিশেষে যেকোনো কর্মী যেকোনো সময় কর্মক্ষেত্রের অসুবিধা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন সম্পর্কে জানাতে পারছেন।
মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রেশনের অভিযানে প্রায়ই অবৈধ অভিবাসী গ্রেফতার হচ্ছেন। তাদের সম্পর্কে ইমিগ্রেশন বলছে, ওয়ার্ক পারমিট বা ভিসা না থাকা, পাসপোর্ট না থাকা, অন্য কোথাও কাজ করে ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গ এবং নিয়োগকর্তা থেকে পালিয়ে আসার মতো অপরাধ ঘটছে। যারা জরিমানা দিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও উল্লিখিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধ সংঘটনের মূলে মানবপাচার ও জবরদস্তিমূলক শ্রমের সূত্র রয়েছে। এসব তথ্যও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, বিদেশি কর্মীদের মধ্যে কোনো অপরাধ নেই।
মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস মানব পাচার সম্পর্কে ‘মাছের মতো মানুষ বিক্রি’ শিরোনামে ১২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানব পাচারের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, পাচারের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়।
এতে বলা হয়, ভালো আয় আর আশ্রয়ের প্রলোভনে পাচারকারীরা সমুদ্রপথে মানুষ পাচার করে। তখনকার মানবাধিকার কমিশনার জেরাল্ড জোসেফ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মানবপাচারের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার যে ভয়ানক ও জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে, সেটা যাতে ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া বা পৃথিবীর কোথাও না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, আমেরিকায় পণ্য প্রবেশে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, কোম্পানি কর্তৃক রিক্রুটমেন্টের অতিরিক্ত অর্থ ফেরত প্রদান, মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অভিযান, মালয়েশিয়ার টায়ার ৩- এ অবনমন এবং আইএলওর গাইডলাইন অনুযায়ী শ্রম প্রেরণকারী দেশ বা মালয়েশিয়ার জন্য শ্রম উৎসের দেশগুলোর করণীয় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারম্যান এম এস সেকিল চৌধুরী বলেন, ডিসিপশন অ্যান্ড ডেবট বন্ডেজ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়। প্রথমত, কাজ, বেতন, সুযোগ সুবিধা, ভিসা, সেদেশে অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে প্রবাসী শ্রমিকদের মিথ্যা, বিকৃত, ভুয়া এবং অসত্য আশ্বাস দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয় যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না। ফলে তারা কোম্পানি থেকে পালিয়ে যান। দ্বিতীয়ত, চাকরি পাওয়ার জন্য দেশত্যাগের আগেই প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। ঋণ করে তারা অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। তারা ডেস্টিনেশন দেশে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। এ চিত্র শুধু মালয়েশিয়া নয় অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও আছে। বিদেশে পাচার বা প্রতারণার শিকার যাতে না হতে হয়, সে লক্ষ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও যৌক্তিক মাইগ্রেশন বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ।