যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্টের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার। রিপোর্টটি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রপাগান্ডা মেশিন’ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। রিপোর্টের অসঙ্গতিগুলো যাচাই-বাছাই করছে সরকার এবং এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে বাংলাদেশ।

বুধবার (১৩ এপ্রিল) এই রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমেরিকান প্রশাসন এক বছর ধরে রিপোর্ট তৈরি করেছে এবং কয়েক ঘণ্টার ভেতরে এই রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া দেখানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের অনেক বৈঠক হবে এবং সেখানে আমরা তাদের কাছে এই বিষয়গুলো জানতে চাইবো এবং আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবো বলে জানান শাহরিয়ার আলম।

গৎবাঁধা রিপোর্ট

মানবাধিকারের যে দুই-তিনটি উপাদান মিডিয়াতে সবসময় প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে মানবাধিকার সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরে অনেক উপাদান আছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এর ব্যাপ্তি অনেক বড়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখানে অতীতের মতো গৎবাঁধা কতগুলো বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকারবিরোধী যেসব প্রপাগান্ডা মেশিন আছে, সেই মেশিনগুলো থেকে প্রাথমিকভাবে ইনফরমেশনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।’

উদাহরণ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে তাসনিম খলিলের কথা বলা হয়েছে। তিনি সুইডেনে আশ্রিত এবং ওই দেশের নাগরিক। তার বিরুদ্ধে সুইডেনের একজন মামলা করেছেন। সেই মামলাটি আওয়ামী লীগের পরিচয় দিয়ে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মামলা করেছেন তিনি আওয়ামী লীগ করেন। কিন্তু এ কারণে তার দায়ভার আওয়ামী লীগের ওপরে চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’

মৌলিক ভুল

পুরো রিপোর্টে অনেক মৌলিক ভুল আছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা বিষয়ে সরকার অত্যন্ত মানবিক এবং আন্তরিক। রোহিঙ্গা নিয়ে পৃথিবীর কোনও দেশ যদি আমাদের মানবতা শেখাতে আসে, তবে আমার মনে হয়—তার নৈতিক স্খলন হয়েছে।’

বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন সই করেনি। কিন্তু ওই কনভেনশনের প্রায় সবকিছুই বাংলাদেশ মেনে চলে। এ বিষয়ে মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা একাধিকবার বলেছি, উদ্বাস্তু চুক্তিটি সই না করলেও সেটির মূল বিষয়বস্তুকে আমরা ধারণ করি। সেটার আলোকে উদ্বাস্তুদের উদ্বাস্তু হিসেবে অভিহিত না করলেও তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বলা হয়েছে, আমরা নাকি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি—সই করিনি এবং আমরা কোনও দায়িত্ব নিই না। এটি সম্পূর্ণ ভুল এবং মিথ্যা।’

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভাসানচর থেকে ১০-১২ জন রোহিঙ্গা পালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে মারা গেছে। এটা কি আমাদের দোষ?’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে মানুষ মারা গেছে এবং প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে যখন আমাদের র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাবেন, তখন যদি গুলি চালাতে হয় এবং কেউ যদি মারা যায়, তখন সেটি আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হবে—এই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

সমকামিতা

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সমকামিতা একটি ফৌজদারি অপরাধ। মার্কিন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে—এর ফলে এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই রিপোর্টে সমকামিতার বৈধতা নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বলা হয়েছে। আপনি একটি মুসলিম দেশ দেখান, যেখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী এবং আমার ধারণা এটা সব ধর্মের পরিপন্থী।’

এ বিষয়ে কোনও দেশ যতই চাপ দিক, বাংলাদেশ কখনোই ছাড় দেবে না। কারণ, এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে। ধর্মের বিরোধিতা করা হবে বলে তিনি জানান।

খালেদা জিয়া

প্রকৃত অবস্থা থেকে অনেক ভিন্ন বিষয়বস্তু রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এখানে খালেদা জিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি রাজনৈতিক বন্দি। তিনি তো রাজনৈতিক বন্দি না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং কর্মকর্তাদের একাধিকবার সবকিছু খুলে বলেছি— সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিও অমূলক ছিল, যখন আমরা দেখলাম—তিনি পায়ে হেঁটে বা হুইলচেয়ারে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছেন।’

দায়মুক্তি

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে এবং দুই-একটি জায়গায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার আলমের ভাষ্য, কোনও বাহিনীতে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। র‌্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আসার পরে আমরা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) বিস্তারিত ডকুমেন্ট দিয়েছি। এখন তারা বলতে পারবে না যে তাদের কিছু দেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একসময় দিতাম না বা এতটা ওপেন ছিলাম না। গত তিন বছরে কতজন পুলিশ, র‌্যাবের কতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটি পরিষ্কারভাবে তাদের জানানো হয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে বলা হয়েছে—দু’একটি ক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৯০ জনকে যখন চাকরিচ্যুত করা হয়, সেটি একটি ঘটনার মধ্যে পড়ে না।’

পৃথিবীর সব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রিপোর্টটি রবিবার নাগাদ আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ভ্রান্ত ধারণাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য যা যা করণীয় সেটা করবো।’

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা আশা করবো, বিদেশি বন্ধুরা আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করবে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো অনুধাবন করবে। আমাদের সংবিধান, ধর্ম ও সংস্কৃতি—এগুলোর প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে দয়া করে সমকামিতার মতো বিষয়গুলো যেন বাংলাদেশে না নিয়ে আসার চেষ্টা করে, সেই অনুরোধ করছি।’