করোনা মহামারিতে রফতানিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। ১৫ মাস ধরে সারা বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এ খাতে প্রায় ৪০১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি রপ্তানির আদেশ বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর অঙ্ক ৩৪ হাজার ১২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি।

এর মধ্যে করোনার প্রথমে ঢেউয়ে বাতিল হয়েছিল ৩৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাতিল হয়েছে আরও প্রায় ৫০ কোটি ডলার। সম্প্রতি আরও প্রায় দেড় কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে বলে জানিছেন পোশাক খাতের শিল্প উদ্যোক্তারা।

দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বছরে এর অঙ্ক গড়ে ৩ হাজার ২৬২ কোটি ডলার। যদিও করোনার প্রভাবে এ খাতের রপ্তানি আয় কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো রপ্তানি আয়ে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে লকডাউন আরোপ করা হয়। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর শোরুম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ক্রেতারা পোশাক রপ্তানির আদেশ বাতিল করে দিতে থাকে।

গত বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল করা হয়। গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমে যায় ৮৩ শতাংশ। সম্প্রতি রফতানিকারকদের ৫টি সংগঠনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাস কারখানা বন্ধ থাকার ফলে গত অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ, এপ্রিলে প্রায় ৮৩ শতাংশ, মেতে সাড়ে ৬১ শতাংশ এবং জুনে আড়াই শতাংশ কমেছিল রফতানি আয়। জুলাই থেকে এ আয় সামান্য হারে বাড়তে থাকে।

গত মার্চে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এপ্রিলে এসে রপ্তানি আয়ে রেকর্ড ৫০৩ শতাংশ, মে মাসে ১১২ শতাংশ এবং জুনে ১১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। জুলাইয়ে প্রথম ১৪ দিনে পোশাক রফতানিতে আয় হয়েছে ১৬৭ কোটি ডলার। গড়ে প্রতিদিন হয়েছে ১২ কোটি ডলার। এটিও রেকর্ড আয়। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতিদিন গড় আয় হয়েছিল ৯ কোটি ডলার।

রফতানিকারকদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারের প্রণোদনার সহায়তা নিয়ে করোনার ক্ষতি কটিয়ে উঠার জন্য যখন আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখনই ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় ১৪ দিন রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়। এর সঙ্গে ঈদের ছুটি ৩ দিন। ফিরে আসতে আরও ২-৩ দিন। সব মিলে মোট ১৯-২০ দিন কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। ২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে এক মাসের রপ্তানি শিডিউল গড়বড় হয়ে পড়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ৬ মাসের রপ্তানি আয়ে।

উদ্যোক্তারা বলেছেন, করোনার নিয়ন্ত্রণ করতে এখন আর লকডাউনের নামে যাতে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য করা না হয় সেই নিশ্চয়তা তারা চান। করোনাকে টিকা বা অন্য কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করলে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, চলমান লকডাউনে বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকরা উভয় সংকটে পড়েছেন। রফতানি আদেশ আছে, কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় তা সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া যাবে না। এতে অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন, বন্দর ও গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের জরিমানার ক্ষতি তো আছেই।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউনের পর ৬ আগস্ট হচ্ছে শুক্রবার। শনিবার ৭ আগস্ট ও রবিবার ৮ আগস্ট কারখানাগুলো খোলা হবে। কারখানা খোলার পরপরই শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে। আবার কারখানা চালু না করলেও শ্রমিকরা বেতনের জন্য ঢাকায় আসবে। তখন নতুন অস্থিরতা দেখা দেবে।

সূত্র জানায়, ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে কঠোর বিধিনিষেধের সময় সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পোশাক ক্রেতাদের ঢাকা অফিস থেকে দ্রুত তাদের প্রধান কার্যালয়কে জানায়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ক্রেতারা। তারা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। অনেকের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এ আশঙ্কায় অনেক ক্রেতা নতুন করে রপ্তানি অর্ডার দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। আগের অর্ডার অনুযায়ী পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব কিনা সেটিও তারা নিশ্চিত হতে চান। ওই সময়ের পর প্রায় দেড় কোটি ডলারের অর্ডার আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

পোশক রপ্তানির সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে শীত, বড়দিন ও লেট সামারকে কেন্দ্র করে। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় লেট সামার বা বিলম্বিত গ্রীষ্মকাল। নভেম্বরে শীত ও ডিসেম্বরে বড় দিন। মোট পোশাকের ৬০ শতাংশ বিক্রি হয় ওই সময়ে। এই বাজার ধরতে জুন, জুলাই ও আগস্ট এ ৩ মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসাবে এখন কারখানা বন্ধ রাখায় রপ্তানিকারকদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

কারখানা বন্ধ থাকায় রফতানির আদেশ বাতিল, স্থগিত বা হাতছাড়া হওয়ার বিষয়ে গার্মেন্ট মালিকরা নিয়মিত বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়শ কারখানার রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে।

এদিকে বিধিনিষেধের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে সৃষ্টি হয়েছে কনটেইনার জট। এতে রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি কম হওয়ায় কনটেইনার এসেছে কম। ফলে এখন রপ্তানি বাড়ায় খালি কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে ঈদের আগে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে।

টাস্কফোর্স কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় নতুন সমস্যার। বিধিনিষেধের কারণে বন্দর ব্যবহারকারীদের অফিস বন্ধ থাকায় পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে যায়। এতে আবার কনটেইনার জট ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে রপ্তানি আবার বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদের ছুটিতে ২৪ ঘণ্টা বন্দর সচল রেখে সব পণ্য খালাস করে কনটেইনার ইয়ার্ড খালি করার কথা। এ জন্য বন্দর সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে ২৪ ঘণ্টা কাজ চালানোর উপযোগী বাড়তি জনবল দেওয়া হয়। কিন্তু বিধিনিষেধের মধ্যে আমদানিকারকদের অফিস বন্ধ থাকায় তারা পণ্য খালাস করতে বন্দরে যেতে পারেননি। ফলে পণ্য খালাস হয়নি।

এতে আমদানি পণ্য বোঝাই কনটেইনারে ভরে গেছে ইয়ার্ড। এখন খালি কনটেইনার মিলছে না। ফলে পণ্যও রফতানি করা যাচ্ছে না। এতে বন্দরে রফতানি পণ্যেরও জট লেগে আছে। আমদানি করা কনটেইনারের মধ্যে ৩৫ শতাংশ তৈরি পোশাক খাতের। বাকি ৬৫ শতাংশ অন্য শিল্প ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের।

এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোক্তাদের দাবি, বেসরকারি খাতের সব অফিস খুলে দিতে হবে। অন্যথায় এর সমাধান হবে না। কেননা একটির সঙ্গে অপরটির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে একটি বন্ধ রাখলে অন্যদিকে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।