হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১৪ স্তরের নিরাপত্তা ডিঙিয়ে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাশ ছাড়া এক শিশু নির্বিঘ্নে কুয়েত এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটে উঠেছে। বিমান উড্ডয়নের প্রস্তুতি নেওয়ার আগ মুহূর্তে জানা যায় শিশুটি ফ্লাইটের যাত্রী নয়। এমনকি তার পাসপোর্ট কিংবা বোর্ডিং পাসও নেই।

বিমানবন্দরে এমন ঘটনায় কেবিন ক্রু ও যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে শিশুটিকে ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে, পাসপোর্ট-বোর্ডিং পাস ছাড়া একজন শিশু কীভাবে উড়োজাহাজে উঠে গেল- এ ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মঙ্গলবার (১২ই সেপ্টেম্বর) কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে এমনই এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় সৃষ্টি হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

জানা যায়, রাত ৩টা ১০ মিনিটে ঢাকা থেকে কুয়েতগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (কেইউ-২৮৪) উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন ১০-১২ বছরের একটি ছেলে শিশু প্লেনের ভেতরে হাঁটাচলা করছিল। কেবিন ক্রু শিশুটিকে সিটে বসার পরামর্শ দেন। তখন শিশুটি একটি সিটে বসে পড়ে।

একপর্যায়ে শিশুটি যেই সিটে বসেছিল পাশের সিটের যাত্রী শিশুটিকে তার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে বসতে বলে। কিন্তু শিশুটি তার বাবা-মায়ের বিষয়ে কোনোকিছু বলতে পারেনি। এ সময় পাশের সিটের যাত্রী বিষয়টি কেবিন ক্রুর নজরে আনলে কেবিন ক্রু তাকে বাবা-মার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। তবে শিশুটি উত্তর দিতে পারেনি। তখন কেবিন ক্রুরা যাত্রী সংখ্যা গণনা করলে একজন যাত্রী বেশি পাওয়া যায়। পরে প্লেনের দরজা খুলে শিশুটিকে বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটির (এভসেক) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখছেন কীভাবে শিশুটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছিল এবং ফ্লাইটে উঠেছিল। তারা দেখতে পান, ইমিগ্রেশন, অ্যাভসেক তল্লাশি ও সিকিউরিটি চেক না করে শিশুটি নির্বিঘ্নে ফ্লাইটে উঠে যাচ্ছে। এটি দেখে অবাক হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে বহনকারী ভিভিআইপি ফ্লাইটটি এয়ারপোর্ট ত্যাগ করার মাত্র ১০ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের এমন চিত্র পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এটি শুধু কোনো অ্যাডভেঞ্চার বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এর সঙ্গে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা। কিংবা বিমানবন্দরের কোনো আদম পাচার সিন্ডিকেটের হাত থাকতে পারে এর সঙ্গে। কারণ ১০-১২ বছরের অজপাড়াগাঁয়ের একটি শিশুর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বিমানবন্দরের এত গেট ডিঙিয়ে ফ্লাইটে ওঠা। কেউ না কেউ তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কিংবা পুরো ঘটনাটি সুপরিকল্পিতও হতে পারে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, এই ঘটনায় প্রথমে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে সাসপেন্ড করতে নির্দেশ দিয়েছি। এরপর তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, কীভাবে ইমিগ্রেশন পার হলো সেটা আমারও প্রশ্ন। তিনি ধারণা করছেন ইমিগ্রেশন করার সময় হয়তো কোনো পরিবারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেও পার হয়ে গেছে। তারপরও এটা তদন্ত করে দেখা হবে।

শিশুটির নাম জুনাইদ মোল্লা। বয়স আনুমানিক ১২ বছর। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বরইহাটি গ্রামের বাঁশবাড়িয়ায় তার বাড়ি। বাবার নাম ইমরান মোল্লা, মাতার নাম জেসমিন আক্তার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজিজুল হক মিয়া যুগান্তরকে বলেন, শিশুটি আমাদের হেফাজতে রয়েছে। তার বাবা-মা এলে সিনিয়র অফিসারদের পরামর্শ নিয়ে শিশুটির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার মিরান বলেন, শিশুটির বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা গোপালগঞ্জে থাকেন। তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা পর্যদের সাবেক বোর্ড মেম্বার কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, কপাল ভালো এয়ারক্রাফটে প্যাসেঞ্জার ফুল ছিল। না হলে এই প্যাসেঞ্জার বাধাহীনভাবে কুয়েত বিমানবন্দরে পৌঁছে যেত। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ত। আর তা যদি হতো তাহলে পুরো দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ত। পুরো এভিয়েশন সেক্টর ভাবমূর্তি সংকটে পড়ত। খুবই আতঙ্কিত হওয়ার মতো ঘটনা। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। মাত্র ১০ ঘণ্টা আগে একটা ভিভিআইপি ফ্লাইট ছিল। এত আইনকানুন, এত এজেন্সি কাজ করছে বিমানবন্দরে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছেলেটি চলে গেল। তাছাড়া একদম বাচ্চা শিশু না ১০-১২ বছরের কিশোর। এখানে অবশ্য সিকিউরিটি শিথিলতা ও গাফিলতি ছিল। কাজেই কোনোভাবেই এই ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে দেখা ঠিক হবে না। অবশ্যই এ নিয়ে সূক্ষ্ম তদন্ত করতে হবে। অন্যথা পুরো দেশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। তিনি আরও বলেন, এই সিকিউরিটি শিথিলতার কারণে আমেরিকার ফেডারেশন এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) কর্তৃক শাহজালালকে গ্রেড-২ করা হয়েছে। সেখানে কিভাবে এ ঘটনা ঘটল তা চিন্তাও করা যায় না। এ নিয়ে আরও কঠোর হতে হবে। কঠোর ভাবে তদন্ত করতে হবে। সিকিউরিটি সিস্টেম আরও কঠোর ও ইন্টিগ্রেটেড হতে হবে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই অত্যাধুনিক ও নিñিদ্র। একজন আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জারকে ১৪টি নিরাপত্তা স্তর ডিঙিয়ে তারপর ফ্লাইটে উঠতে হচ্ছে। কোনো প্যাসেঞ্জারের পকেটে একটি আলপিন থাকলেও সেটি নিরাপত্তা স্ক্রিনিংয়ে ধরা পড়ে। কোনো প্যাসেঞ্জার বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে গেটে থাকা আনসার সদস্যকে পাসপোর্ট-টিকিট দেখিয়ে তারপর ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। এরপর আর্চওয়ের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে ফের নিরাপত্তাকর্মীর মাধ্যমে পুরো শরির তল্লাশি করতে হয়। এরপর বোর্ডিং কার্ড ও পাসপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে প্রবেশ করতে হয়। ইমিগ্রেশন শেষ করে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে বিমানবন্দরের গ্রিন এরিয়ায় প্রবেশ করতে হয়। এরপর ফাইনাল গেটে জুতা, ঘড়ি, বেল্ট খুলে এবং স্ক্রিনিং মেশিনে ব্যাগ স্ক্রিনিং করে বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে ফাইনাল রুমে প্রবেশ করতে হয়। এই গেটে বোর্ডিং কার্ডের অর্ধেক অংশ কেটে রাখে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা। এরপরও দুই দফায় বোর্ডিং কার্ডের বাকি অংশ দেখিয়ে উড়োজাহাজে প্রবেশ করতে হয়। এভাবে মোট ১৪টি স্তর ডিঙিয়ে একজন প্যাসেঞ্জারকে উড়োজাহাজে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু এত স্তরের কোথাও নিরাপত্তাকর্মীরা শিশুটির বোর্ডিং কার্ড, পাসপোর্ট দেখতে চাইল না এটাই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইমিগ্রেশন চেকিং ও ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে বিমানবন্দরের ট্রানজিট এরিয়ার প্রবেশ। এছাড়া অ্যাভসেক তল্লাশি শেষে এয়ারলাইন্সের ফাইনাল গেট পার হলো কিভাবে-সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, শিশুটি কীভাবে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল এবং কীভাবে নিরাপত্তা স্তরগুলো পার হলো তা তদন্ত করে খুঁজে বের করা হবে। যারা গাফিলতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়ীদের শাস্তি দেওয়া হবে। বেবিচক চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে।