সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ব্যারিস্টার মইনুলের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার জুনিয়র ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম।

তিনি জানান, গত কয়েকদিন ধরে ব্যারিস্টার মইনুল রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সকালে রাজধানীর বারিধারা জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজা হবে। পরবর্তীতে আজিমপুর কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে শায়িত হবেন তিনি।

খ্যাতিমান সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে পিরোজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ছাত্রজীবনে স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যান এবং মিডল টেম্পল-ইন এ ভর্তি হন।  সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৬৫ সালে তিনি হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের লন্ডন প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি কমনওয়েলথ প্রেস ইনস্টিটিউটেরও একজন সদস্য ছিলেন। ইউরোপীয় কমন মার্কেট কমিশনের আমন্ত্রণে তিনি ব্রাসেলস পরিদর্শন করেন। চীনের জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে ১৯৬৯ ও ১৯৮৯ সালে সরকারি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে চীন সফর করেন।

১৯৬৯ সালে বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর ইত্তেফাক সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৭৩ সালে ইত্তেফাকের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। একই বছর বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া-কাঁঠালিয়া আসন থেকে নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি নিবর্তনমূলক যেকোনো আইন পাশের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে উদার ও স্বাধীন মতামত রাখার জন্য তিনি ‘নিউ নেশন’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন, যা পরবর্তীকালে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।

ব্যারিস্টার মইনুল বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ও প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে প্রথম গঠিত প্রেস কমিশনেও তাকে সদস্য করা হয়। প্রেস কমিশনের রিপোর্ট প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন (২০০০-২০০১) এবং আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় মূল্যবান অবদান রাখেন।

১৯৯০ সালে বহুল আলোচিত ‘৩১ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’র তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ও স্বাক্ষরদাতা। এই বিবৃতিতে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে নির্দলীয় জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়েছিল।

ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি এক বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষায় এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ : বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’, ‘গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি’, ‘ঘুরে দাঁড়াতে হবে’, ‘আমার জীবন আমাদের স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ : কি চেয়েছি, কি পেয়েছি’, ‘অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া’ প্রভৃতি।

ব্যারিস্টার মইনুলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। আরও শোক জানিয়েছেন মাওলানা মতীন স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব দেলোয়ার হোসেন সাঈদ।