সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বাবা, মা ও মেয়েকে গলাকেটে হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনের রহস্য উন্মােচন করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। একই সঙ্গে আলামত উদ্ধারসহ ঘাতককে আটক করা হয়েছে। আটক ব্যক্তির নাম রাজিব ভৌমিক। তিনি নিহত বিকাশ সরকারের আপন ভাগিনা।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান মন্ডল।

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে তাড়াশ থেকেই বিকাশের ভাগিনা রাজীব কুমার ভৌমিককে (৩৫) গ্রেফতার করে পুলিশ। রাজীব সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথ ও নিহত বিকাশের বড়বোন প্রমিলা রাণীর ছেলে। আগের দিন যখন বিকাশদের খোঁজ মিলছিল না তখন তার মাসতুতো ভাই ও পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাকর্মীদের সাথে রিপোর্ট করতে থানাতেও যান রাজীব।

পুলিশ সুপার জানান, মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গেই ব্যবসায় যুক্ত ছিলো বড় বোন প্রমিলা সরকারের ছেলে রাজিব ভৌমিক। আর ব্যবসার টাকা নিয়েই মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের শুরু। দ্বন্দ্ব আর লোভ শেষ পর্যন্ত খুনিতে রূপান্তিরত করে ভাগিনা রাজিবকে।

ভিকটিম বিকাশ চন্দ্র সরকারের বড়বোন প্রমিলা রাণীর ছেলে রাজীব। হত্যাকারী তার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তার মারা যাওয়ার পর বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে ২০২১ সাল থেকে মামা বিকাশ চন্দ্র সরকারের সাথে যৌথভাবে খাদ্যশস্য কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত হন। ভিকটিম বিকাশ চন্দ্র সরকার তার ভাগিনা রাজীর কুমার ভৌমিককে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ২০ লাখ টাকা দেন। এরপর ব্যবসা চলমান থাকাকালীন রাজীব কুমার ভৌমিক তার মামাকে বিভিন্ন ধাপে ব্যবসার লভ্যাংশসহ প্রায় ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও চলতি বছরে এসে রাজীবের কাছে তার মামা অতিরিক্ত ৩৫ লাখ টাকা দাবি করেন। এরপর বিকাশ চন্দ্র সরকার গত ২২ জানুয়ারি দাবিকৃত টাকা ৭-৮ দিনের মধ্যে ভাগিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য অনেক চাপ দেন এবং টাকার জন্য রাজীব ও তার মাকে (ভিকটিমের বোন) ফোনে অনেক বকাবকি করেন।

 

রাজীব কুমার ভৌমিক টাকা ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং মামার বকাবকিতে মনে কষ্ট পাওয়ায় তার মামাসহ পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এরই অংশ হিসেবে গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে মামাকে ফোন করে পাওনা টাকা নিয়ে বাসায় আসতে চান রাজীব। ভিকটিম বিকাশ চন্দ্র সরকার তাড়াশের বাইরে থাকায় তার ভাগিনাকে টাকা নিয়ে সরাসরি তার তাড়াশের বাসায় এসে মামীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাসাতেই থাকতে বলেন।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, রাজীব যখন বাসায় যান তখন তার মামি সন্ধ্যা পূজা করছিলেন। রাজীব কুমার বাসায় মামার অনুপস্থিতির সুযোগে তার মামি এবং মামাতো বোন তুষিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর একপর্যায়ে ভাগিনা রাজীবকে কফি খাওয়ানোর জন্য তার মামী সন্ধ্যাকালীন পূজা শেষে বাসার নিচে দোকানে কফির প্যাকেট কিনতে গেলে রাজীব ব্যাগে করে রাস্তা থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে কিনে আনা লোহার রড দিয়ে তার মামাতো বোন তুষির মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেন। এতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইতোমধ্যে তার মামী কফি কিনে বাসায় ঢুকলে তাকেও একইভাবে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। মামী এবং মামাতো বোনকে হামলার পর তিনি চলে যেতে চান। এর মধ্যেই তার মামা বাসায় চলে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তার মামা বাসায় ঢুকলে তাকেও প্রথমে রড দিয়ে আঘাত করেন। এরপর তার মামাকে গলাকেটে হত্যা নিশ্চিতের পর লাশ টেনে বেডরুমে নিয়ে যান। এর মধ্যে তার মামী ও মামাতো বোনের গোংরানির শব্দ এলে পরে গিয়ে তাদেরও গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে বাইরে দিয়ে তালা মেরে চলে যান। পথে লোহার রড একটি পুকুরে ফেলে যান এবং রক্তমাখা হাসুয়াসহ ব্যাগটি নিজ বাড়িতে রাখেন।

এসপি আরও বলেন, আমরা বিকাশের ফোনের একটি কল রেকর্ড থেকে প্রথম সূত্র পাই। এরপর ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য খাটিয়ে এবং সার্বিকভাবে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরে রাজীবকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর রাজীব আমাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন। তবে এটাই সত্য যে, এভাবে পালাক্রমে রাজীব একাই তিনজনকে হত্যা করেন। এরপরও আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করছি। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

প্রেস কনফারেন্সে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. সামিউল আলম, উল্লাপাড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত কুমার সূত্রধর, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার ওসি জুলহাজ উদ্দীন, তাড়াশ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।