জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সম্প্রতি কোটা আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত আসে।
আইন অনুযায়ী, সরকারের নির্বাহী আদেশে এই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির ও তাদের অন্য কোনো সংগঠন রাজনীতিসহ কোনো ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করতে পারবে না। ১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে প্রতিষ্ঠার পর এ নিয়ে মোট তিনবার জামায়াত নিষিদ্ধ হলো। এরমধ্যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান আমলে একবার এবং বাংলাদেশে দুই বার।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্তসহ কয়েকটি মামলার রায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ-সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আলোচনায় থাকলেও বিষয়টি গতি পায় সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতার পর। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে গত ২৮ থেকে ২১ জুলাই নজিরবিহীন সহিংসতা এবং সরকারি হিসাবে দেড়শ মানুষের প্রাণহানি, অজস্র রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলার জন্য এর পেছনে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন সরকারের
একাধিক মন্ত্রী-নেতা। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন গত বুধবারই জারি হওয়ার কথা ছিল। তবে আইনি প্রক্রিয়া সারতে এক দিন সময় লেগে যায়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সকালে আইন মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠিয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং করে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘কিছুক্ষণের মধ্যে’ প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এরপর বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরপাত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের? এক রিট পিটিশনের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগও ওই রায়কে বহাল রেখেছেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাই ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮(১) এ দেওয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। এ আইনের তফসিল ২-এ জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল- বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
আইনে যা আছে : ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা আছে, এই আইনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী- সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তি বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে। আইনটিতে ‘সন্ত্রাসী কাজ’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখ-তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে; তাহলে তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া এ ধরনের কাজের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র, সহায়তা, প্ররোচনা, সম্পত্তির ক্ষতি করা বা করার চেষ্টা করা; বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা বা নিজ দখলে রাখা এবং সংঘাতে লিপ্ত হলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।
আইনটিতে বলা আছে, ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যে কোনো সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে। একই ধারায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন নম্বর ১৯৭৩ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা কোনো সন্ত্রাসী কাজ করে বা চেষ্টা চালায় বা অংশ নেয় বা সন্ত্রাসী কাজে সহযোগিতা করে, তাহলে সে নিষিদ্ধের মানদ-ের আওতাভুক্ত হবে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত যে কোনো ব্যক্তি বা সত্তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মালিকাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন অথবা নির্দেশে কাজ করে এমন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা, তাদেরকে আশ্রয়দানকারীও সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে গণ্য হবে।
শাস্তির বিধান ও আপিল : আইনটিতে বলা আছে, কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ- এবং অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। আইনে আরও বলা আছে, নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সত্তা আদেশ প্রদানের তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে পুনঃনিরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে এবং সরকার আবেদন প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পন্ন করবে। আর পুনঃনিরীক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করা হলে এর ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারবে।
সহিংসতা দমনে প্রস্তুত সরকার : এদিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো সহিংসতা হলে তা দমনের সক্ষমতা সরকারের রয়েছে বলে সাফ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছি। ওদের বিরুদ্ধে আমরা সেই একাত্তর থেকে যুদ্ধ করছি। সুতরাং এগুলো দমনে আমাদের সক্ষমতা অনেক আছে।’
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পর যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে সতর্কতা অবলম্বন করেছে সরকার। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে ডিএমপি। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় এবং মোট চারবার নিষিদ্ধ হলো জামায়াত : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীকে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে জামায়াত প্রথমে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে মোর্চা করে এবং ১৯৭৯ সালের ২৭ মে নিজ নামে আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকেই জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি উঠতে থাকে। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক রায়ে জামায়াতকে ক্রিমিনাল সংগঠন আখ্যা দেওয়ার পর দল হিসেবেও তার বিচারের দাবি ওঠে। তবে সে বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন হয়ে ওঠে ১৯৭৩ সালে প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধন। কিন্তু আইন সংশোধন না করায় সেই পথে হাঁটা যায়নি। এর আগে ১৯৪১ সালে আবুল আলা মওদুদীর প্রতিষ্ঠিত এই দলটিকে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও পরে পাকিস্তানে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল।