বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত আট মাসে একটি বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে, যা দেশের ইতিহাসে নতুন একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই সময়ে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, সরকারি অর্থ লোপাটকারী এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সিদ্দিকের পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন।
২০২৪ সালের পুরো সময়ে ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৬১ কোটি টাকা। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গেল আট মাসে সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
দুদকে দায়ের হওয়া বিভিন্ন দুর্নীতির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত আট মাসে (আগস্ট-মার্চ) আদালতের নির্দেশনায় এসব সম্পদ ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ১৯১ একর জমি, বিদেশে ৫৮২টি ফ্ল্যাট, দেশে ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি, ২৩টি কোম্পানির আট লাখ ৮৮ হাজার ডলার, ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৪৮০ ইউরো, তিনটি কোম্পানি ও তিনটি জাহাজ। এছাড়া এক হাজার ১০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৮১৭ কোটি ১৪ লাখ। অবরুদ্ধ করা হয়েছে আট হাজার ৭১৩ কোটি টাকার শেয়ার, ৬৬০ গ্রাম সোনা, এক লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নয়টি বিও হিসাবে নয় কোটি ১৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা স্থিতি। ব্যাংক স্থিতি সাত লাখ ১৩ হাজার ডলার ও ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮০ ইউরো। সবমিলিয়ে গত আট মাসে ক্রোক ও অবরুদ্ধ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি।
ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সিদ্দিকের পরিবারের সম্পদ, শিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও সালমান এফ রহমানসহ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-এমপি ও আমলা। আরও আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম।
এবিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানান, “গত আট মাসে সম্পদ জব্দের এই পরিমাণ নিঃসন্দেহে বিপুল। এত কম সময়ে এত পরিমাণ সম্পদ জব্দ করার রেকর্ড এর আগে কখনো হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “এটি দুর্নীতি দমন কমিশনের দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতির প্রমাণ, এবং এই ধরনের পদক্ষেপ আগামীতে আরও জোরদার হবে।”
দুদক জানায়, এ ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকবে এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে, যারা অবৈধভাবে অর্থপাচার ও সরকারি সম্পদ লোপাট করছে।
এই ব্যাপক সাফল্য দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশার আলো দেখিয়েছে। জনগণ মনে করছে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে দেশ থেকে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে এবং মানুষের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগরণ তৈরি হবে। তবে, এসব পদক্ষেপের কার্যকর প্রয়োগ এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আর না ঘটে।
এছাড়া, দুদক জানিয়েছে যে, যদি আদালতের কোনো বিশেষ নির্দেশনা না থাকে, তবে তাদের ব্যবস্থাপনা ইউনিটের মাধ্যমে এসব সম্পদের দেখভাল করা হবে। এই ইউনিটের কাজ হলো ক্রোক এবং অবরুদ্ধ করা সম্পদগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে এগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হয় এবং যাতে কোন ধরনের অপব্যবহার না ঘটে।
সম্প্রতি দুই হাজার কোটিরও বেশি সম্পত্তি জব্দ করার পাশাপাশি, আগামী দিনগুলোতে আরো বড় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা।