চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীন দুটি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দিতে সরকার দুটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য চুক্তি হয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে, যা ইউরোপীয় কোনো দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো খাতে একক সর্ববৃহৎ প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ।
একই দিন ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত পৃথক দুই অনুষ্ঠানে চুক্তি দুটি সই হয়েছে। তবে স্বাক্ষরটা প্রকাশ্যে হলেও চুক্তিতে বিস্তারিত কী কী শর্ত রয়েছে এবং কী কী তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
যদিও নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, চুক্তির বিভিন্ন শর্তের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। এদিকে চুক্তির বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পক্ষ বিবৃতি দিয়েছে।
বন্দরের টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বেশ কিছুদিন ধরে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এবং বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করে আসছে। এ ছাড়া বন্দরের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে অন্তর্র্বতী সরকারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সংগঠনগুলোর নেতারা। তারা খুব দ্রুততার সঙ্গে এসব চুক্তি করা এবং চুক্তির বিষয়গুলো প্রকাশ না করায় সরকারের সমালোচনা করছেন। বিদেশি কোম্পানির হাতে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার আলোচনার মাঝেই সরকার বন্দর ব্যবহারকারীদের ট্যারিফ বাড়ায়। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশিদের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার জন্যই মাশুল বাড়ানো হয়েছে।
ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্সমোলার বলেন, টেকসই লজিস্টিকস ছাড়া রপ্তানি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। ডেনমার্ক শুধু বিনিয়োগ নয়, টেকসই ও সবুজ লজিস্টিকস গড়ে তুলতেও কাজ করছে। শুধু এই প্রকল্পই নয়– ডেনমার্ক নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং দক্ষ শ্রমবাজার গঠনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘লালদিয়া শেষ নয়। এখান থেকে বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির যাত্রা শুরু। আমরা অনেক সময় দেখেছি, ভালো ইঞ্জিন ভুল চেসিসে বসানো হয়। লালদিয়া সেই ভুল ভাঙার ইতিহাস।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণে ৫৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে এপিএম টার্মিনালস। ২০৩০ সালে সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষ হবে। টার্মিনাল নির্মাণ শেষে এপিএম টার্মিনালস অপারেটর হিসাবে কাজ করবে। পিপিপি বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এটি নির্মাণ হবে। চুক্তির মেয়াদ ৩৩ বছর। পরে আরও ১৫ বছর বাড়ানো যাবে। টার্মিনালটির বার্ষিক হ্যান্ডলিং ক্ষমতা হবে ২০ লাখ টিইইউ। এতে দেশের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
এদিকে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেল সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ। গতকাল বিকেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং মেডলগের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হয়।
২২ বছর মেয়াদি চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ও মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম আনিসুল মিল্লাত স্বাক্ষর করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌ পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কাছাকাছি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই টার্মিনাল বাংলাদেশের লজিস্টিক ও বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নয়নে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
চুক্তি অনুযায়ী মেডলগের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেডলগ বাংলাদেশের মাধ্যমে টার্মিনালের কার্যক্রম, সরবরাহ ও অটোমেশন তত্ত্বাবধান করবে। পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম, সরবরাহ ব্যবস্থা ও অটোমেশন তত্ত্বাবধান করবে। এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সামাল দিতে টার্মিনালের সুবিধা বাড়ানো হবে এবং বার্ষিক হ্যান্ডলিং সক্ষমতা এক লাখ ৬০ হাজার টিইইউতে উন্নীত করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই চুক্তির মাধ্যমে লোকসানে থাকা পানগাঁও টার্মিনাল লাভজনক হবে। লালদিয়া টার্মিনালের অবকাঠামোও গড়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মানে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। যথাযথ নিয়ম মেনেই চুক্তির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কাজ হলে এই দুটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে। বাড়াবে আয়ও।’












