দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে মব ভায়োলেন্স থেকে সরে আসতে তাগিদ দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বুধবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি ও ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ সেন্টার। সেখানে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে তৈরি একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
গণতন্ত্রের পাঠ নিয়ে সেখানে মির্জা ফখরুল বলেন, “ডেমোক্রেসির মূল কথাটা হচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে একমত না হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা তাকে আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব। দ্যাট ইজ ডেমোক্রেসি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা এখানে অন্যের মতকে সহ্য করতে চাই না, আমরা তাকে উড়িয়ে দিতে চাই…এই জায়গা থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রায় দেয়া হচ্ছে, আর অন্যদিকে মবক্রেসি বা ভায়োলেন্স তৈরি করা হচ্ছে। এটা কিসের আলামত জানি না। তবে আমার মনে হয়, ওই রায়ের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে বিশেষ একটা মহল ভিন্নদিকে দৃষ্টি দিতে কাজ করছে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ফখরুল বলেন, “কোন দল কে জিতল, কে হারলৃএটা জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানটা শক্তিশালী হলো কী না, আমাদের জুডিশিয়ারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট কি না, আমাদের মিডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট কি না, আমাদের পার্লামেন্ট ইফেক্টিভ কি না, আমাদের দেশ আইনের শাসনে চলছে কি না, সুশাসন চলছে কি না, মানুষের সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষা এবং মানবাধিকার আমরা রাখতে পারছি কিনাৃএই বিষয়গুলোকে নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতে কাজ করতে হবে।”
দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফেরানোর তাগিদ দিয়ে ফখরুল বলেন, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে না চাইলে গণতন্ত্রের পথে ফিরতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। সেজন্য বিএনপিসহ যারা গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে, তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘ট্রানজিশনাল পিরিয়ড’ হিসেবে বর্ণনা বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘নির্বাচন সামনে হলেও এটি কোনো শেষ লক্ষ্য নয়; বরং দেশকে গণতন্ত্রে ফেরানোটাই, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলাটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। আজকে আমরা একটা ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে আছি। একটা দোলাচল চলছে। নির্বাচনের সময় ঘোষণা হয়েছে। এখনো শিডিউল হয়নি। হবে আশা করছি। নির্বাচন কিন্তু সব শেষ নয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা ডেমোক্রেসিতে ফিরে যাওয়া এবং ডেমোক্রেটিক কালচার গড়ে তোলা—এটাই সবচেয়ে বড় অভাব।’
টেকসই রাষ্ট্র গড়তে হলে বিচার বিভাগ, সংসদ, গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব।
গত ১৬ বছরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হওয়া দমন–পীড়ন, গুম-খুন ও মিথ্যা মামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। পৃথিবীর কোনো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এই রকম অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গেছে কি না জানি না। ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। ২০ হাজারের মতো নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। এগুলো ইতিহাসে আনতে হবে, ডকুমেন্টে আনতে হবে। এসব ঘটনা গবেষণার মাধ্যমে নথিভুক্ত করতে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
সংস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘আজকে সংস্কারের কথা বলা হয় জোরেশোরে। অথচ তারা আগেই সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন। সংস্কারের দাবিকে কেউ ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে উপস্থাপন করলে তা হবে সংকীর্ণতা।’
বিএনপি বিপ্লবী দল নয়, বরং লিবারেল ডেমোক্র্যাট হিসেবে সব ধর্ম-বর্ণ-মতের মানুষকে নিয়ে ‘রেইনবো স্টেট’ গঠনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, বিএনপির অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার—‘উই আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটস’।
গণতন্ত্রের পক্ষে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থানের কথা স্মরণ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ছোট্ট বিবৃতিতেই দল ও জাতির জন্য পথনির্দেশনা আছে—‘প্রতিশোধ নয় প্রতিহিংসা নয়, আসুন আমরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে সবাই একযোগে কাজ করি।’ বিদেশে থাকা তারেক রহমানও গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখছেন বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জিয়া পরিষদ নেতা অধ্যাপক বি এম নাগিব হোসেন, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপি’ বইয়ের সম্পাদক বাবুল তালুকদার। অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিনসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।












