যখনই কোনও বিগ বাজেটের ছবি রিলিজ হয়, তখন ছবির নির্মাতা ও অভিনেতারা সব মেট্রো শহরের খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলের অফিসে ঘুরে ঘুরে ছবির প্রচার করেন, সাক্ষাৎকার দেন – যে প্রক্রিয়াটার নাম ‘প্রোমোশন’। এছাড়া বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রামেও সদলবলে আবির্ভূত হয়ে তারা ছবির প্রচার করে থাকেন – আর এই তালিকায় ‘কপিল শর্মা শো’ খুবই জনপ্রিয় নাম, ছবির কলাকুশলীরা সেখানে ডাক পেলে সিনেমাটাও ‘জাতে উঠেছে’ বলে গণ্য করা হয়।
কিন্তু এই প্রচলিত ‘প্রোমোশন সার্কিটে’ বা কপিল শর্মা শো-তে ঢুকতে না-পেরেও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বলিউড মুভি এখন ভারতে আলোচনার কেন্দ্রে। তার বড় কারণ – ছবিটির হয়ে ‘প্রোমোশন’ করেছেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ছবিটির নাম ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’, পরিচালনা করেছেন বলিউডের ব্যতিক্রমী ধারার পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কাশ্মির উপত্যকা থেকে উগ্রপন্থীদের হুমকিতে যেভাবে রাতারাতি হিন্দু পণ্ডিতদের এক কাপড়ে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, সেই ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করেই এই বাস্তবধর্মী ছবিটি বানিয়েছেন তিনি, আর নানা কারণে গত শুক্রবার (১১ মার্চ) সিনেমা হলে মুক্তির সময় থেকেই ছবিটিকে ঘিরে চলছে তুমুল বিতর্ক।
এই পটভূমিতেই শনিবার বিকালে দিল্লিতে ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী, তার অভিনেত্রী স্ত্রী পল্লবী জোশী ও প্রযোজক অভিষেক আগরওয়ালের সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য তার বাসভবনেই ওই মুভির একটি বিশেষ স্ক্রিনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
পরে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের ছবি টুইট করেন পরিচালক ও প্রযোজক দুজনেই। সঙ্গে লেখেন, ‘ছবিটি দেখে প্রধানমন্ত্রী যে তারিফ করেছেন ও প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ!’
ব্যাস, এর পর থেকেই ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে কাশ্মির ফাইলস নিয়ে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেছে। বিবেক অগ্নিহোত্রী আগেই জানিয়েছিলেন, কপিল শর্মা শো-তে তার টিম ডাক পায়নি কারণ বলিউডের ‘মাফিয়া’-রাই ঠিক করে কারা সেখানে আমন্ত্রণ পাবে আর কারা পাবে না। তখন থেকেই জনপ্রিয় কমেডিয়ান কপিল শর্মাকে বয়কট করার ডাক উঠতে থাকে, মোদির প্রোমোশনের পর যথারীতি ‘হ্যাশট্যাগ বয়কটকপিলশর্মাশো’ আরও ট্রেন্ড করতে শুরু করছে।
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ‘কপিল শর্মা ভাঁড় মে যাও (আস্তাকুড়ে যাও)। মোদিজি স্বয়ং যে ছবির প্রোমোশন করছেন তার আবার কীসের প্রচার লাগে?’
বলিউডের মাফিয়া বলতে তিনি কাদের বোঝাচ্ছেন, ইতোমধ্যে বিবেক অগ্নিহোত্রীও সে নামগুলো প্রকাশ্যে এনেছেন। দাবি করেছেন, করণ জোহরের নেকনজর না-থাকলে বলিউডের কোনও ছবি নাকি কলকে পায় না। আর এক পরিচালক বিধুবিনোদ চোপড়া ও তার স্ত্রী অনুপমা চোপড়ার বিরুদ্ধেও তোপ দেগেছেন – বলেছেন ফিল্ম সমালোচক অনুপমা চোপড়ার সংস্থা ‘ফিল্ম কম্পানিয়ন’ আর একটি মাফিয়ার মতো কাজ করে, করণ জোহরের প্রযোজিত ফ্লপ ছবি ‘গেহরাইয়া’ নিয়ে সেখানে প্রবল মাতামাতি হলেও ‘কাশ্মির ফাইলস’ নিয়ে তারা একটি শব্দও লেখেনি। বিবেক অগ্নিহোত্রীর আগের ছবিগুলোকেও খাটো করার অপচেষ্টা করেছে।
বলিউড ভক্তরা কেউ তার কথা বিশ্বাস করছেন, কেউ হয়তো করছেন না – কিন্তু ঘটনা হলো এই সব বিতর্কের জেরে কাশ্মির ফাইলস যে ধরনের প্রচার পেয়ে গেছে, সাম্প্রতিক কালে হিন্দি ছবির দুনিয়ায় তার তুলনা বিরল। খবরের কাগজ-চ্যানেল-টিভি শোর চেনা সার্কিটের বাইরেও ছবিটি ভারতে যে ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে তা প্রায় নজিরবিহীন। অনুপম খের, মিঠুন চক্রবর্তী, দর্শন কুমার বা পল্লবী জোশীর মতো উঁচু মানের অভিনেতারা ছবিটিতে থাকায় তার জন্যও আছে আলাদা আকর্ষণ।
ছবিটির বিষয়বস্তুর কারণেও ভারতে এক শ্রেণীর দর্শকের কাছে ‘কাশ্মির ফাইলস’ অন্য রকম আবেদন নিয়ে এসেছে। দেশের শাসক দল বিজেপি বহুদিন ধরেই বলে আসছে, কাশ্মিরি পণ্ডিতরা নিজদেশে শরণার্থীর জীবন কাটাতে বাধ্য হলেও ভারতের মিডিয়া বা অন্য দলগুলো তাদের নিয়ে কখনো টুঁ শব্দটি করে না – সেই পটভূমিতে বিজেপি-ঘেঁষা ভারতীয়রা অনেকেই মনে করছেন, এতদিন বাদে একটি বলিউড মুভি নির্মম সত্যিটা বলার সাহস দেখাল, পণ্ডিতদের দুর্দশাটা সেলুলয়েডে তুলে ধরল।
বহু ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আওয়াজ উঠছে, দল বেঁধে সবাই মিলে টিকিট কেটে সিনেমা হলে গিয়ে এই মুভিটা দেখা দরকার। বুকমাইশো-র মতো অনলাইন বুকিং সাইটে ইচ্ছে করে ‘সোল্ড আউট’ দেখিয়ে এই ছবি দেখতে লোকজনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে – এই ধরনের প্রচারও চলছে।
ছবিটির সাহসী বিষয়বস্তু যে গভীর ভাবনার দাবি রাখে, তা অবশ্য স্বীকার করছেন প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম ক্রিটিকরাও। জাতীয় দৈনিক দ্য হিন্দুস্তান টাইমস যেমন কাশ্মির ফাইলসের সমালোচনায় লিখেছে : ‘এই ছবি আপনাকে কাঁদাবে, চোখ ভেজাবে, লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ কীভাবে রাতারাতি শরণার্থী হয়েছিলেন সেই ট্র্যাজেডি চোখের সামনে দেখতে দেখতে আপনি আতঙ্কে শিউড়ে উঠবেন। এটা বলিউডের সেই ধরনের কোনও মসালা মুভি নয় যা রামধনুর রঙে রাঙিয়ে কোনও ঘটনাকে তুলে ধরেছে – বরং একটা নির্মম সত্যি ঘটনাকে যেভাবে বলা উচিত ঠিক সেভাবেই বলেছে।’
এবং এরপর খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘এনডোর্সমেন্ট’ কাশ্মির ফাইলস মুভিটিকে দেশে একটি অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।