নির্মলেন্দু গুণ। বাংলা ভাষার পাঠক নন্দিত কবি। তার কবিতার সরল ও সাবলীল উচ্চারণে প্রেমিক ও কৃষকের আত্মার হৃদস্পন্দন চিত্রিত হয় শৈল্পিকভাবে। সংগ্রামকে শুধু নিজের জীবনে গেঁথে ক্ষান্ত হননি, সংগ্রামী মানুষের তিনি সহযাত্রী। রাজনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন-অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সবসময় অবস্থান নিয়েছেন এ কবি।
পাঠকপ্রিয় কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: প্রেমাংশুর রক্ত চাই, বাংলার মাটি বাংলার জল, চাষাভূষার কাব্য, মুজিব, লেনিন ইন্দিরা, নিরঞ্জনের পৃথিবী, যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই, মুঠোফোনের কাব্য, কাম-কাননসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাব্যেগ্রন্থ রয়েছে তার। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। কবির সাহিত্য জগৎ নিয়ে আলোচনা হয় কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের সঙ্গে। সেই আলোচনার অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো।
মনি হায়দার : আপনাকে সবাই কবি হিসাবে জানে। আপনি তো ডাকাতি মামলারও আসামি ছিলেন। কীভাবে?
নির্মলেন্দু গুণ : দু’টো কারণে আমার নামে হুলিয়া হয়েছিল। প্রথমত, ১৯৬৬ সালে আমি নেত্রকোনা থেকে একটা কবিতার সংকলন বের করেছিলাম, আমি সম্পাদনা করেছিলাম, নেত্রকোনার কবিদের নিয়ে, বিশজন কবির কবিতা ছিল, নাম ছিল ‘সূর্যফসল’। কেউ কেউ একটু বিপ্লবী ছিল, শ্রেণিসংগ্রাম সচেতন ছিল, পাকিস্তান নামক শোষক রাষ্ট্র থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষাও ছিল, মানুষকে উসকানিমূলকও ছিল। সংকলনটি প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের তৎকালী সাবডিভিশনাল অফিসার এবং গোয়েন্দা বিভাগ প্রেস থেকে সেটি সিজ করে। মুদ্রক ও প্রকাশক নুর মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে যায় এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে তার ছয় মাসের জেল হয়। আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়না জারি হয়।
এর কিছুদিন পরে বারহাট্টা স্টেশনে ডাকাতি হয়। একজন ডাকাত ধরা পড়ে, সে স্বীকার করল যে যারা তাকে ডাকাতিতে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে একজন চিকন ও লম্বা দেখতে, কিন্তু নাম বলতে পারেনি। আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম আমার এলাকার পুলিশের কর্মকর্তা জানতেন, তখন তিনি সেখানে আমার নাম দিয়ে দেন। আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। অনেকদিন বাড়িতে যেতে পারতাম না, পুলিশ বারবার বাড়িতে আসত। তখন বাধ্য হয়ে আত্মীয়স্বজন সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়ার।
মনি হায়দার : পালিয়ে অনেকের বাড়িতে ছিলেন, আর যখন পালিয়ে সারতে পারছিলেন না, তখন সিদ্ধান্ত হলো পরিবার থেকে যে আপনি পালিয়ে ভারত চলে যাবেন। আপনার বাবা আপনাকে টাকাও দিয়েছিলেন। আপনি যখন স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন সকালবেলা চা খাচ্ছিলেন, তখন পিঠের ওপর একটি হাত পড়ল। সে হাতটি কার ছিল?
নির্মলেন্দু গুণ : সে আমার বন্ধু ছিল। বিএসসিতে আমার সহপাঠী ছিল। সে পরীক্ষায় পাশ করেছিল, হুলিয়া থাকার কারণে পড়াশোনা করতে পারিনি, ফলে আমি ফেল করেছিলাম। বিএসসি পাশ করে একটা স্কুলে মাস্টারি পেয়েছিল। তার নাম ছিল ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী। আমাদের সীমান্তবর্তী স্টেশন, যেটি অতিক্রম করে আমার ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার কথা সে জায়গায় সে একটা স্কুলে মাস্টারি করত। আমি যখন সকালের দিকে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকেছি নাস্তা করব। আমাদের পরিবারের পিতা-মাতা, ভাইবোন এসে ভারতের পথে আমাকে বিদায় জানিয়ে যাচ্ছে। আমার মনটাও খারাপ, দেশ ছেড়ে যাব, পরিবার পরিজন ছেড়ে যাব। তখন ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হলো। সে পিঠে হাত রেখেছিল এমনভাবে যেন সে বলছে, যাসনে। আমার বন্ধুটির কথা মনে দাগ কাটল। সে আমাকে নিয়ে গেল। আমি ইলিয়াস আহম্মেদকে স্মরণ করছি। সে আমার শেষ যাত্রাপথের বাধাটি ছিল। সে আমাকে আটকে দিল।
মনি হায়দার : ওখান থেকে চলে এলেন ঢাকা, এবং দেখা হলো আজকের বিখ্যাত নাট্যকার মামুনের রশীদের সঙ্গে। উঠলেন মামুন ভাই বা মামুনের সঙ্গে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে।
নির্মলেন্দু গুণ : মামুনও আমাকে বলেছিল আপনি ঢাকা চলে আসেন।
মনি হায়দার : আবুল হাসানের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
নির্মলেন্দু গুণ : শরীফের কেন্টিনে পরিচয়। আবুল হাসান ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, আমি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছিলাম।
মনি হায়দার : গুলিস্তানের এক হোটেলে খেয়েছিলেন। খেয়ে বাসে উঠেছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ : খেয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। হোটেলে পয়সা না দিয়ে। পকেটে পয়সা ছিল না, সারাদিন খাওয়া হয়নি। ভালো করেই খেয়ে নিলাম, আমি তো জানি পয়সা নেই, দৌড় দেব সিদ্ধান্ত নিয়ে খেয়েছিলাম। কাউন্টারে এসে নাটক করলাম কত হইছে, সে বলল, এত, রুটির দাম এত টাকা কীভাবে, সে হিসাব দিচ্ছে, আমি দিলাম দৌড়।
মনি হায়দার : আপনার জীবনে প্রেম, নারী, জুয়া পরস্পর একসঙ্গে ছিল, বিপরীত সঙ্গেও ছিল, মদ, নারী, জুয়া মিলে যে জীবন সে জীবনে আপনি বিজয়ী হয়েছেন নাকি পরাজিত হয়েছেন?
নির্মলেন্দু গুণ : বিজয়ী শব্দটির মধ্যে অহংকারভাব প্রকাশ পায়, আমি প্রকাশ্যে সেভাব প্রকাশ করতে চাই না। তবে আমি পরাজিত হইনি এমনই ভাবি। সবকিছু থেকে আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে আমার কবিতার মধ্যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটেছে। ঘটনাচক্রে আমি পুস্কিনের বাড়ি গিয়েছিলাম, দস্তয়ভস্কির বাড়িটা একটু দূরে ছিল, যাওয়া হয়নি, এলাকাটা একটু দূরে থেকে দেখেছি। দস্তয়ভস্কি একজন বড়মাপের জুয়াড়ি ছিলেন, তিনি জুয়ার টাকা সংগ্রহ করার জন্য লিখতেন, এরকম কথিত আছে। আমার অভিজ্ঞতাগুলো আমার জীবন গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
আমি একজন ‘স্পোর্ট-লাভার’, ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে বলেছি যে, এই গ্রন্থ রচয়িতা যদি বড় হয়ে কোনো ফুটবলার হতো তাহলে সুবিচার হতো। কিন্তু তিনি আমার প্রতি সুবিচার করেননি। আমাকে লেখকে পরিণত করেছেন।
মনি হায়দার : বঙ্গবন্ধু আপনার কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য’ জেলে বসে পড়েছিলেন এবং আপনিই প্রথম কবি, বাঙালি কবি শেখ মুজিবুর রহমানকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং তাকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ : সে কবিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বা তাকে উৎসর্গ করার কবিতা এই প্রথম। ৬৭ সালে, ১২ নভেম্বর কবিতাটি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পেছনে একটা ঘটনা আছে। শহীদুল্লাহ কায়সার সাহেব তখন সংবাদের সম্পাদক, তাকে আমি চাপ দিয়েছিলাম যে, আপনি যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা কবিতাটা প্রকাশ না করেন, তাহলে আমি কবিতাটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়ম খাঁনকে উৎসর্গ করে পয়গাম পত্রিকায় প্রকাশ করব, আপনি কি তাই চান?
তিনি কিন্তু পরের সংখ্যাতে প্রকাশ করেন। তিনি ভাবলেন, যে রকম পাগল ছেপেও দিতে পারে।
কবিতাটা খুব দীর্ঘ ছিল। লতিফ সিদ্দিকী তখন ছাত্রনেতা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভিপি ছিলেন। তিনি ছয় দফার কারণে জেলে ছিলেন, তারই মাধ্যমে সংবাদের কবিতাটি বঙ্গবন্ধু দেখেন। বঙ্গবন্ধু খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমাকে নিয়ে একজন কবিতা লিখেছেন, এটি তার কাছে খুব আনন্দের বিষয় হয়েছিল।
মনি হায়দার : আপনি অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছেন। যখন প্রেমের কবিতা লিখেন তখন একজন কবি হিসাবে নারীর কল্পনা থাকে তা কতটা বাস্তব ছিল?
নির্মলেন্দু গুণ : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য আমি নারীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। তার বন্দনা রচনা করার মধ্যে যত আনন্দ পেয়েছি, আমার রাজনৈতিক কবিতা রচনা করে তা পাইনি।
মনি হায়দার : কাশবন আপনার গ্রাম, যেখানে আপনি জন্মেছিলেন সেখানে একটা স্কুল করেছেন, লাইব্রেরি করেছেন, ভাস্কর্য করেছেন কয়েকটা, একটা শহিদ মিনার করেছেন। আর কি করার ইচ্ছা আছে?
নির্মলেন্দু গুণ : আমি নেত্রকোনাতে সরকারের কাছ থেকে জমি নিয়েছি আট শতাংশ, সেখানে একটা উন্নতমানের লাইব্রেরি করতে চাই, সেখানে গ্রামের মানুষ যেসব বই পড়ে সেগুলো ছাড়া আরও গ্রন্থ রয়েছে, যাতে গবেষকরা কাজ করতে পারেন। গবেষকরা যাতে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক যেমন- শিল্পকলার ওপর, ইতিহাসের ওপর, দর্শনের ওপর কাজ করতে পারে। সেজন্য আরও উন্নতমানের লাইব্রেরি করতে চাই। সেখানে আবৃত্তি চর্চার ব্যবস্থা যেন থাকে।