মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায় কর্পোরেট গাজোয়ারীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী কৃষকদের ওপর পুলিস প্রশাসনের নারকীয় আক্রমণ করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে জয় কিষাণ আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গ শাখা। রোববার (২ জুলাই) এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নিন্দা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কা থানার অধীনে সমাসপুর, দাদনটোলা, ইমামনগর, ঘোলাকান্দি গ্রামগুলির মধ্যে দিয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ লাইনের নিয়ে যাওয়ার কাজ করছে আদানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি। এই কাজের ফলে কৃষক, বিশেষত আম ও লিচুর কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকদের ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তারা রুটি-রুজি হারাবে। বাস্তুর ওপর দিয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়ার দরুন তাদের জমির বিক্রয় সম্ভাবনা ও জমির মূল্য হ্রাস হবে। নানাবিধ ক্ষয়–ক্ষতির আশঙ্কায় তারা তাদের জমির ওপর দিয়ে সংযোগ নিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে কিন্তু, এই অনিচ্ছুক কৃষক এবং বাস্তু মালিকদের সাথে কোনরকম আলোচনা না করেই আদানি গোষ্ঠীর মালিকানাধীন কোম্পানি একতরফাভাবে এবং গায়ের জোরে তাদের জমির ওপর দিয়ে সংযোগ নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ফলে প্রতিবাদীরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অবস্থানে নামতে বাধ্য হয়েছে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সেই আন্দোলন চলছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, এটা দুঃখের বিষয় যে শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব এবং স্থানীয় পুলিশ নির্লজ্জভাবে কর্পোরেটদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনকারীদের হুমকি, এমনকি প্রাননাশের হুমকি দিচ্ছে। মারধর ও মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার মত পদক্ষেপ নিয়ে আন্দোলন ভাঙতে চাইছে তারা। আজ ফরাক্কা থানার পুলিশ সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বিনা প্ররোচনায় প্রতিবাদীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর অমানুষিক, বর্বর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। পুলিশের লাঠির আঘাতে ও ছোঁড়া পাথরে বহু প্রতিবাদী রক্তাক্ত হয়েছে। গুরুতর জখম অন্তত ১২ জন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে।
দিল্লির সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতা যোগেন্দ্র যাদব বলেন, “এটা ভারি দুঃখের বিষয় যে কর্পোরেট আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থে পুলিশ প্রশাসন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী কৃষকদের ওপর নারকীয় রক্ত ঝরানো আক্রমণ করেছে। অবিলম্বে এই অত্যাচার বন্ধ করার ও দোষী পুলিশকর্মীদের সাজা দেবার আবেদন জানাচ্ছি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ওনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে এই আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার কৃষক বিরোধী আইন এনেছিল যার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন হয় এবং কৃষকদের জয় হয়। বাংলায় যদি কৃষকদের উপর আদানির স্বার্থে অত্যাচার হয়, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা নীরব দর্শক হবেনা। প্রতিবাদ ও প্রতিকার আমরা করতে জানি, করে দেখিয়েছি।”
জয় কিষাণ আন্দোলনের সর্বভারতীয় সভাপতি অভীক সাহা বলেন, “পুলিসের এই বর্বরোচিত কাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন করে, রাজ্যের কৃষকদের বিপুল সমর্থনে ক্ষমতায় এসে বসে রাজ্যের শাসকদল আজ কৃষকদেরই রক্ত ঝরাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ কৃষক প্রতিবাদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, পাথর ছুড়ছে। রাজ্যে অনিচ্ছুক কৃষক বা ব্যক্তিদের থেকে জমি নেওয়া হবেনা, আলোচনা করে সম্মতি থাকলে তবেই জমি নেওয়া হবে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই সব প্রতিশ্রুতি আজ কোথায় গেল? আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য এবং প্রমাণ আছে স্থানীয় শাসক দলের নেতা কর্মীরা এবং থানার আই সি সরাসরি আদানি গোষ্ঠীর দালালি করছেন। পুলিশের কাজ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ কর্পোরেট দালালের ভুমিকায় আসবে কেন? আমি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং অনুরোধ জানাচ্ছি, আন্দোলনদমনকারী নেতা, গুন্ডা এবং পুলিশদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করতে হবে এবং দোষী পুলিশ এবং আই সি–কে অবিলম্বে সাসপেন্ড করতে হবে। জয় কিষাণ আন্দোলনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিনিধি দল আজই রওনা হচ্ছে। সরকার কৃষক পিটিয়ে জমি, জীবন জীবিকা কেড়ে নিতে পারবে না।”
জয় কিষাণ আন্দোলনের রাজ্য সম্পাদক প্রবীর মিশ্র বলেন, “এই বর্বতার নিন্দা জানাবার ভাষা নেই। জয় কিষাণ আন্দোলন প্রতিবাদকারীদের পাশে আছে এবং থাকবে। আজই আমরা একটা দল নিয়ে আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়ের সমাধান করতে হবে। গায়ের জোরে অনিচ্ছুক কৃষক/ব্যাক্তির জমির ওপর কোন কাজ করা যাবেনা। অন্যথায় রাজ্যে বড় আন্দোলন করা হবে।”
উল্লেখ্য, আদানি গ্রুপের ঠিকাদার সংস্থা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এর তার নিয়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। আর সেই তার নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গত মাসের ২৬ তারিখ বেশ উতপ্ত হয়েছিল ফরাক্কার জাফরগঞ্জ। ২রা জুলাই অর্থাৎ শনিবার আবার ফরাক্কাতে বিদ্যুৎ তার নিয়ে যেতে গিয়ে পুলিশের সাথে বচসা তৈরি হয় গ্রামের বাসিন্দাদের। পরে সেই বচসার রূপ নেয় রণক্ষেত্রের। পুলিশ ও গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত হন সামশেরগঞ্জ পুলিশ লাইনের পুলিশ কর্মী ধনঞ্জয় সরকার সহ আরো চারজন ,অনদিকে আহত হন বেশ কয়েকজন গ্রামবাসিও। গুরুতর আহত অবস্থায় সকলকে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে একাধিক পুলিশকর্মী ও গ্রামবাসীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় জঙ্গিপুর মহকুমা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে।
এই ঘটনায় ফরাক্কার কংগ্রেসের জেলা পরিষদ সদস্য আসিফ ইকবাল ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশও গ্রাম বাসিন্দাদের সাথে কথা বলেন। ওই ঘটনায় জেলা পরিষদ সদস্য আসিফ ইকবাল নিজেও আহত হন। প্রায় তিন মাস ধরে ইলেকট্রিক পোল বা টাওয়ার তৈরী শুরুর থেকেই পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীদের বচসা শুরু হয়। ফরাক্কা পুলিশ সূত্রে জানা যায় এই ঘটনায় একাধিকবার গ্রামবাসীকে চিঠি করা হলে তারা কোন সদ উত্তর দেননি। বরং চিঠি পেয়েও এড়িয়ে গেছেন ঘটনাকে। অন্যদিকে গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন তাদের একবারও চিঠি করা হয়নি বরং ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে নানাভাবে অত্যাচার করে পুলিশ। ঘটনায় আটক মহিলা পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ১৮ জন গ্রামবাসী। আহত ৪ পুলিশ কর্মী যার মধ্যে গুরুতর আহত এক পুলিশ কর্মী। ঘটনায় জখম ১২ জন গ্রামবাসী।