ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় সাগরে। তাই সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এর শিকার হয়। পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। তবে এগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। যেগুলো উপকূল বা স্থলভাগে আঘাত হানে সেগুলো ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস বলছে, সমুদ্রতীরবর্তী বহু দেশ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় হারিকেন, চীনে টাইফুন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাইক্লোন।

ইতিহাসের সূত্র ধরে একেক পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সঙ্গী হয়ে থাকে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ব-দ্বীপ। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টিসহ নানা দুর্যোগ হানা দেয় এই দেশে। বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশেও বেশ বড় বড় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।

১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় (ভোলা সাইক্লোন):
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর চট্টগ্রামে আঘাত হানে এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি। বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয়। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। সেই সময় ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। হিসাব অনুযায়ী ১৯৭০ সালের প্রবলতম ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। যাদের মধ্যে ১ লাখই ছিল জেলে। বেশির ভাগই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এছাড়া অসংখ্য গবাদিপশু এবং ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এই সাইক্লোনটি সরাসরি বরিশালের মাঝখান দিয়ে উঠে আসে। ভোলাসহ অনেক এলাকা পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৭০ এর ঘূর্ণিঝড়।

১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়:

বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ২৯শে নভেম্বরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী। এই ঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৫ হাজার ৭০৮ জন মানুষ প্রাণ হারায়। ঝড়ে সেবার প্রায় ৭০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন।

১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়:
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ২৯-৩০শে এপ্রিলে সংগঠিত হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়কে ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগের সাইক্লোটির কারণে ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। বাস্তুহারা হয়ে পড়েন ১ কোটিরও বেশি মানুষ। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়গুলো ২/৩ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। কিন্তু এই সাইক্লোনটি ছয় ঘণ্টা ধরে স্থলভাগে আসে এবং তাণ্ডব চালায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটি মানুষ।

২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর:

২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঝড়টিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। তুলনামূলক কম মানুষ মারা গেলেও এই ঘূর্ণিঝড়ে অবকাঠামোগত অনেক ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। রেডক্রসের হিসাবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও সরকারিভাবে ৬ ছয় হাজার বলা হয়েছিল।

২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা:
২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা। এই ঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বলা হয়, বাংলাদেশে আঘাত হাত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘৭০ ও ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে।

উলে­খযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়

বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড়- ১৮৭৬ সালের পহেলা নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি অনেকের কাছে বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ২ লাখ মানুষ, যখন ১০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়।

১৯৬০ সালের ৩১শে অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে পহেলা অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়

২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস এর পূর্বাভাস দেওয়া হলেও পরে তা বার্মার উপকূলে আঘাত হানে। মিয়ানমারে এর প্রভাবে বহু ক্ষতি হয়।

২০১৩ সালের ১৬ই মে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় ‘মাহাসেন’’

২০১৫ সালের ৩০শে জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে ৫-৭ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’

২০১৬ সালের ২১শে মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’

২০১৭ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’।

২০১৯ সালের মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আঘাত হানে। যার বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ উঠেছিল ২৫০ কিলোমিটার।

তথ্যসূত্র: বিবিসি