ডিজেলশূন্য হয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রের কোনো তেলের স্টেশনে ডিজেল পাওয়া যায়নি; কয়েকটি স্টেশনে পেট্রোল বিক্রি হয়েছে, তবে দিন শেষ হওয়ার আগেই তার মজুত শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

এদিকে, ডিজেলের অভাবে শ্রীলঙ্কায় পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছেন দেশটির বাসিন্দারা, এমনকি বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সড়কবাতিগুলোও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে শ্রীলঙ্কার সরকার।

শ্রীলঙ্কার পরিবহনমন্ত্রী ডিলুম আমুনুগামা এএফপিকে বলেন, ‘সরকারি গ্যারেজে মেরামতের জন্য যেসব বাস পড়ে আছে, সেগুলো থেকে ডিজেল নিয়ে আপাতত কিছু সরকারি বাস চালু রাখা হয়েছে। তবে কতদিন এভাবে চালানো যাবে, আমরা জানি না।’

বেসরকারি মালিকানায় থাকা বাসগুলোর ক্ষেত্রে সে ‍সুবিধা নেই। বাসমালিকরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার কিছু বাস চললেও শুক্রবার থেকে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বেসরকারি পরিবহনসেবা।

শ্রীলঙ্কার পরিবহন সেবাদানকারী বাসগুলোর ২৫ শতাংশ সরকারি, বাকি ৭৫ শতাংশ বেসরকারি মালিকানাধীন।

দেশটির বাসমালিক সমিতির চেয়ারম্যান গেমুনু উইজেরাত্নে এএফপিকে বলেন, ‘পুরনো মজুত থেকে ডিজেল নিয়ে এখনওবাস চালাচ্ছি, কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যার মধ্যে যদি ডিজেল না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে আগামীকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হবে আমাদের।’

ডিজেল না থাকায় শ্রীলঙ্কায় দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে বিদ্যুৎ না থাকার সমস্যাও। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকতো দেশটির বিভিন্ন এলাকা, বর্তমানে এই সময়সীমা আরও ৩ ঘণ্টা বেড়ে হয়েছে ১৩ ঘণ্টা।

শ্রীলঙ্কার সরকারি বিদ্যুৎ পরিষেবা সংস্থঅ সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্দিনান্দো এএফপিকে বলেন, ‘জেনারেটরে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ডিজেল আমাদের কাছে নেই। এজন্য এ সমস্যা হচ্ছে।’

‘সরকার বলেছে, আগামী দু’দিনের মধ্যে ডিজেলের সরবরাহ আসবে। যদি আসে, তাহলে ভালো; কিন্তু যদি (সরবরাহ) না আসে, সেক্ষেত্রে সামনে লোডশেডিংয়ের মেয়াদ আরও বাড়বে।’

শ্রীলঙ্কার মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের এক তৃতীয়াংশ আসে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো থেকে; কিন্তু বর্তমানে সেসব প্রকল্পসমূহের উৎপাদনও কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ফার্দিনান্দ।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে রুটিন সার্জারি বন্ধ রেখেছে শ্রীলঙ্কার অনেক হাসপাতাল। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে দেশটির টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও।

এদিকে, একদিকে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট, আর অন্যদিকে খাদ্য ও ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে ‍বৃদ্ধির জেরে দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষজন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শহরে জনগণ বিক্ষোভ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এত খারাপ পরিস্থিতি কখনও দেখা যায়নি দেশটিতে।

দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছর দীর্ঘ খরার কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় শ্রীলঙ্কার কৃষি উৎপাদন এবং ইস্টার সানডেতে মুসলিম জঙ্গীগোষ্ঠীর বোমার আঘাতে প্রায় ৩০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পর্যটনশিল্প। অনেক বিদেশি পর্যটক শ্রীলঙ্কায় আসার পরিকল্পনা বাতিল করেন।

সেই ক্ষতি যখন সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি, সে সময়েই হানা দেয় করোনা মহামারি— যার প্রভাবে দীর্ঘ দুই বছর প্রায় বন্ধ ছিল পর্যটন খাত। ফলে দেশটির রিজার্ভের মজুতে টান পড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ একেবারে কমে যাওয়ায় সেই মজুত আর বাড়ানো যায়নি। বর্তমানে বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে শ্রীলঙ্কার আর্থিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

তবে দেশের সাম্প্রতিক এই দুরাবস্থার জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন কলোম্বোভিত্তিক থিংক ট্যাংক সংস্থা অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের মুরতাজা জাফেরজি।

এএফপিকে তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে বাজেট ঘাটতি, মহামারির আগে অযৌক্তিক কর কাটছাঁট এবং ধনী শ্রীলঙ্কানদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সামঞ্জস্যহীনভাবে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পরিষেবাখাতে যথেচ্ছ ভর্তুকি দেওয়ার ফলাফলই বর্তমানের এই দুর্বিষহ অবস্থার মূল কারণ।